গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ পরিবার–পরিজন নিয়ে সেখানে রাতের আহার করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের খুব কমই নিরাপদে ফিরতে পেরেছেন। অনেকে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, যাঁদের অনেকে অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারি যে আগুন লাগার পর স্বল্প সময়েই সেখানে অগ্নিনির্বাপণ দল পৌঁছাতে পেরেছে এবং তারা ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। আক্রান্ত মানুষদের উদ্ধার করতে স্থানীয় লোকজনও সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। তারপরও প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা যাবেন, এটা ছিল ভাবনারও অতীত। এতে আবারও প্রমাণিত হলো, ঢাকার ভবনগুলো কতটা অনিরাপদ।
ঠিক কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত বা কীভাবে আগুন লেগেছে, তা আমরা এখনো জানি না। তদন্তে হয়তো বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। তবে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, সিঁড়ির পাশে গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল। সেটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শোনা গেছে, নিচতলার রেস্তোরাঁ থেকেই প্রথম আগুন লাগে। ‘কাচ্চি ভাই’ নামে অধিক পরিচিত ওই ভবনে একটি তলা বাদে সব কটি তলায় রেস্তোরাঁ ছিল। একটি রেস্তোরাঁয় ৫০ জন খেতে গেলে সংখ্যাটা হয় ৩৫০। এ ছাড়া রেস্তোরাঁর কর্মীরা তো আছেই।
এ রকম বহু মানুষের ভিড় যেখানে, সেখানে সুরক্ষিত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেখানে সেটি ছিল না। প্রথম প্রশ্ন, আগুন লাগার পর ওপরের তলার লোকজন যে বেরিয়ে আসবেন, সেই সুযোগ তাঁদের ছিল কি না!
শুরুতেই এই নিচতলায় আগুন লেগে বহির্গমনের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আগুন লাগলে কোনো ভবনে লিফট ব্যবহার করা যায় না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে হয়। অনেক ভবনে বিকল্প সিঁড়িও থাকে। এই ধরনের হাই অকুপেন্সি ভবনে সুরক্ষিত বহির্গমনের পথ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দুর্ঘটনায় পড়া ভবনটিতে বিকল্প জরুরি সিঁড়ি কি ছিল?
প্রতিটি ভবনে প্রশস্ত ও বিকল্প সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন। ভবন নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের অনেকগুলো বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বিল্ডিং কোডগুলো মেনে চলতে হয়। কিন্তু অনেক ভবনমালিকই সেটা মানেন না। আবার তদারককারী যেসব সংস্থা আছে, তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। আমাদের আইন আছে কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে ভবনের ভেতরের ডিজাইনে এমন পরিবর্তন করা হয় যে এতে ভবনের ফায়ার সেপারেশন নষ্ট হয়, ফলে আগুন ও ধোঁয়া একতলা থেকে অন্য তলায় সহজে ছড়িয়ে পরে। তৃতীয়ত, ভবনে আগুন লাগলে দ্রুত মানুষকে বের করে আনতে যেসব প্রশিক্ষণ থাকতে হয় কর্মীদের, তাঁদের সেটি ছিল কি না। অনেক সময় আমরা দেখি যে এ ধরনের ঘটনায় একসঙ্গে অনেক লোক নামতে গিয়ে পায়ের চাপে পড়েও অনেকে মারা যান। অনেকে ভয়ে লাফিয়ে পড়ে বা তার বেয়ে নামতে গিয়ে আহত বা নিহত হন।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের অনেকের শরীরে আগুনে পোড়ার চিহ্ন ছিল না। এর অর্থ, তাঁরা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এমনকি দোতলার রেস্তোরাঁ থেকে অনেকে বের হতে পারেননি, সেখানেও বেশ কজন মারা গেছেন। কিন্তু খুব দ্রুত বিভিন্ন তলায় ধোঁয়ায় পূর্ণ হয়ে গেছে। নিচের তলা থেকে আগুন ওপরে উঠতে তো সময় লেগেছে। সে ক্ষেত্রে ওপরের তলার লোকজনকে দ্রুত বের করতে পারলে অথবা অগ্নি–সুরক্ষিত সিঁড়ি থাকলে এভাবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।
এসব থেকে অনেকগুলো দুর্বলতা বেরিয়ে আসে। প্রথমত, এসব ভবন করার পর অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের অনেকগুলো নির্দেশনা থাকে। এ ক্ষেত্রে সেগুলো মানা হয়েছে কি না। আর মানা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না। তদন্ত হলে হয়তো বিস্তারিত জানা যাবে। তবে আমরা খালি চোখে যেটি বলতে পারি, ওই ভবনে আগুন লাগলে নিরাপদে বের হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল না। সেখানকার কর্মীরা প্রশিক্ষিত হলে, আগুন নেভানোর ব্যবস্থাদি থাকলে ও শুরুতে আগুন নেভানো সম্ভব হলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
কেবল বেইলি রোডের ভবনটি নয়, ঢাকা শহরে এ রকম কাঠামো অনেক আছে। দুর্ঘটনা ঘটার পরই আমরা জানতে পারি, সেখানে কী কী ত্রুটি বা দুর্বলতা ছিল। ধানমন্ডিতে দেখেছি, সেখানে অনেক রেস্তোরাঁয় যেতে লিফটের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। বিকল্প সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। এ রকম অবস্থায় আগুন লাগলে সমূহ বিপদ।
প্রতিটি ভবনে প্রশস্ত ও বিকল্প সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন। ভবন নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের অনেকগুলো বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বিল্ডিং কোডগুলো মেনে চলতে হয়। কিন্তু অনেক ভবনমালিকই সেটা মানেন না। আবার তদারককারী যেসব সংস্থা আছে, তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। আমাদের আইন আছে কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না।
এর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। নিমতলীর ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। চুড়িহাট্টার ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে—৯ বছর আগে। আরও পাঁচ বছর পেরিয়েছে কিন্তু পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমেনি।
সরকার পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। ব্যবসায়ীরা নাকি সেখানে যেতে চান না। ব্যবসায়ীদের সমস্যা থাকলে সরকার তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করুক। কিন্তু এভাবে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম বানিয়ে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারেন না তাঁরা।
অগ্নিকাণ্ড অন্যান্য দেশেও হয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে মানুষ অধিক সচেতন বলে মানুষের প্রাণহানি কিংবা সম্পদের ক্ষতি কম হয়। যেকোনো কাঠামো সেটি রেস্তোরাঁ কিংবা কারখানা—অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে দুর্ঘটনা কমানো যায়। একই সঙ্গে ভবন ব্যবহারকারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটি স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ব্যবহারকারীর জন্য সত্য।
প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তার জন্য ভবনটি যাঁরা নির্মাণ করেন, তাঁদের সজাগ থাকতে হবে। আইন মেনে চলতে হবে। প্রতিটি ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ও বহির্গমনের পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা থাকতে হবে। কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।
গ্যাস সিলিন্ডারের মতো দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও নিয়মিত তদারক করতে হবে। সেটি অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি কারখানা বা ভবন পরিদর্শন বিভাগকেও। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি।
● ড. মো. ইয়াসির আরাফাত খান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক