আগে জানা দরকার শিক্ষার্থীরা কী চাইছে

প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা চলছে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী। নতুন এই শিক্ষা কার্যক্রম বা পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে উঠেছে এন্তার অভিযোগ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে ও আসছে, তেমন কিছুই পড়ছে না। এমনকি বাড়ির কাজও করতে হচ্ছে না। তাদের যা পড়ানো হচ্ছে, তাতে বাড়ির কাজ, প্রাইভেট-টিউশনি তেমন কিছু লাগছে না। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যা শিখছে, বাড়িতে এসে যা করছে, তা আদতে কোনো ‘পড়াশোনা নয়’ বলে মনে করছেন অভিভাবকেরা। এ জন্য নতুন এই শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিও জানাচ্ছেন তাঁরা।

পরীক্ষাবিহীন এই পড়াশোনায় আস্থা নেই অভিভাবকদের। তাঁরা চাইছেন বাচ্চারা প্রচুর পড়বে, হোমওয়ার্ক থাকবে, টিউটর থাকবে। তা না হলে এ কিসের পড়াশোনা। শিক্ষার্থীরা পড়বে, মুখস্থ করবে এবং পরীক্ষা দেবে। উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীরা যদি কিছু না-ই লেখে, তাহলে শিক্ষকেরা কীভাবে তাদের মূল্যায়ন করবেন।

অভিভাবকদের এ রকম একটি ধারণা হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। আমার মেয়ে যে স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি হয়েছিল ২৪ বছর আগে, সেই স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই ছিল না। ‘স্কুলে পরীক্ষা নাই’—এ কথা শুনে আমরাও প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

তাহলে কীভাবে বাচ্চার মূল্যায়ন হবে, বাচ্চারা কীভাবে পরীক্ষা বিষয়টিকে চিনবে? ফোরে উঠে কি তারা ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারবে কি না ইত্যাদি নানান সংশয় ছিল। তা ছাড়া আমরাই বা কীভাবে বুঝতে পারব যে শিশু কেমন পড়া শিখছে? কিন্তু খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, শিশুরা সবই শিখল নিজেদের মতো করে। পরীক্ষা ও হোমওয়ার্ক ছিল না বলে বেশ একটা স্বাধীনতা ভোগ করত ওরা। পড়াশোনায় ছিল না কোনো বাড়তি চাপ। খুবই অবাক হলাম যে শিশু যা যা শেখার সবই শিখেছে। ফোরে উঠে ঠিকই পরীক্ষা দিতে পেরেছে। সম্ভবত সে রকমই কোনো ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ।

প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কিছু বই নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা বুঝতে পেরেছি আসলে বইগুলোতে কী আছে? দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের পরিচিত চিত্র এখানে স্থান পায়নি। নতুন শিক্ষাক্রমে সেই পদ্ধতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শিক্ষার্থীরা প্রথমে কিছু বিষয়ে পড়ে জানবে, তারপর সেই বিষয়ের সঙ্গে মেলে এমন বিষয় নিজেরা খুঁজে বের করবে। অর্থাৎ পঠিত বিষয়টি তারা ঠিকমতো বুঝতে পারল কি না, এ রকম আরও উদাহরণ দেবে বা পরীক্ষা দেবে দলভিত্তিক বা এককভাবে।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষক বা শিক্ষিকা তাকে বুঝতে সহযোগিতা করবেন। তবে বড় অসুবিধা হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষিকাকে প্রথমে বিষয়টি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মানে বিষয়টি এমনভাবে পড়তে ও পড়াতে হবে, যেন শিক্ষার্থীর ধারণা স্পষ্ট হয় এবং শিক্ষার্থী একই রকম আরও বিষয় খুঁজে বের করতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট না হলে, সেই কাজ তারা করতে পারবে না। অর্থাৎ সেই বিষয়ের ওপর কাজ করা ও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

যতটুকু বুঝেছি, নতুন পদ্ধতিতে প্রথমে বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে এবং পরে প্র্যাকটিক্যাল করানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা প্রথমে কাজ করবে, বিষয়টি বুঝবে এবং তারপর শিখবে। তাদের এসব কার্যক্রম দেখে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকেরা। থাকবে না নানা ধরনের পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষা না থাকা নিয়েই চরম ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা। ‘পরীক্ষাবিহীন’ পড়াশোনায় অধিকাংশ অভিভাবকই যেন আস্থা রাখতে পারছেন না।

নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়ার তেমন কোনো সুযোগও থাকছে না। শিক্ষার্থীদের যেসব কাজ দেওয়া হচ্ছে, তা স্কুলেই শেষ হচ্ছে। বাসায় গিয়ে পড়ার বা হোমওয়ার্ক করার প্রয়োজন হচ্ছে না। আমাদের পরিবারগুলোতে গেড়ে বসা ধারণা যে ছাত্রছাত্রীরা সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়তে বসবে, বাড়ির কাজ করবে, কোচিংয়ে যাবে, ভালো রেজাল্ট করবে এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে ব্যাপারটা ঠিক এমন হবে না।

অন্যদিকে শিক্ষকেরাও এ ক্ষেত্রে বেশ বিপাকে পড়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কাছ থেকে নতুন পদ্ধতি চালিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের যেমন সর্বাত্মক সাপোর্ট দরকার, তেমনি প্রয়োজন নিজেদের উৎসাহ ও মনোযোগ। এই যে নতুন নিয়ম, অন্য ধরনের পড়াশোনা ও পড়ানোর পদ্ধতি—এটা শিক্ষকদের আত্মস্থ করতে হবে প্রথমে। কারণ, একটি বিষয়কে অনেক উদাহরণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর জন্য তাঁদেরও জোরালো প্রশিক্ষণ দরকার। এই কথাটা বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলাও হচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে যাঁরা পাঠদান করছেন, তাঁরা অনেকেই শিক্ষাক্রমের এই নতুন কারিকুলাম ও পাঠ্যবই সম্পর্কে ঠিকমতো জানেন না বা বুঝতে পারছেন না। বিশেষ করে যাঁরা প্রবীণ শিক্ষক, তাঁরা পড়ানোর এই পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ—কোনোটাকেই খুব একটা পছন্দ করছেন না বলে জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, এত প্র্যাকটিক্যাল করানো ঝামেলাপূর্ণ। পরীক্ষা ছাড়া বোঝা মুশকিল যে কোন ছাত্রছাত্রী কেমন পড়াশোনা শিখছে।

অবশ্য মাউশি এবং এই বিষয়-সম্পর্কিত অন্যান্য কর্তৃপক্ষ অভিভাবক ও শিক্ষকদের এই অভিযোগ মানতে চাইছেন না। তাঁরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাঁধ থেকে পরীক্ষার বোঝা নামিয়ে হাতে-কলমে শেখানোর প্রক্রিয়ায় নেওয়ার লক্ষ্যেই নতুন এ শিক্ষাক্রম। তবে হ্যাঁ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণঘাটতি দূর করতে হবে। কারণ, এটি বড় বাধা। আর এ বাধা দূর করতে দ্রুত নতুন শিক্ষাক্রমে শতভাগ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে চায় মাউশি। সেই সঙ্গে তারা এ-ও মনে করছে যে অভিভাবকেরা যদি একটু পজিটিভ হন এবং ধৈর্য ধরেন, তাহলে আলোচনা করার মাধ্যমে তাদের বোঝানো সহজ হবে।

ঢাকার স্কুলে ক্লাস সিক্সের একজন ও সেভেনের দুজন শিক্ষার্থীও জানাল, এই পদ্ধতিতে তারা খুশি। কারণ, তাদের ওপর চাপ কমেছে। বই দেখে মুখস্থ করতে হচ্ছে না। অনেক কিছুই তারা শিখতে পারছে দলগত কাজ করে বা শ্রেণিতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ও রোল-প্লে করে। ওরা জানাল, কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতে বা বক্তব্য রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। তবে শিক্ষকেরা বলছেন উপস্থাপনা করতে করতে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই তিনজনের কথায় মনে হলো তারা এ পদ্ধতিতে পড়াশোনাটা উপভোগ করছে।

শিক্ষার্থীরা পড়ার চাপ কম বলে খুশি হলেও অভিভাবকেরা স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। তারা ভয় পাচ্ছেন নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ছাড়াই যেহেতু শিক্ষকেরা ও শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা মূল্যায়ন করবেন, তাতে মূল্যায়ন নিরপেক্ষ না-ও হতে পারে। অভিভাবকেরা বলছেন, সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চাদের পরীক্ষা ও রেজাল্ট না হলে, আমরা কীভাবে বুঝব যে আমাদের সন্তান কেমন পড়াশোনা করছে।

তা ছাড়া ঢাকার বাইরের স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা প্রভাবিত হয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের বেশি নম্বর দিতে পারেন বলে অনেক অভিভাবক গণমাধ্যমের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তবে শিক্ষার্থীদের কাজ মূল্যায়নে শিক্ষকদের ভূমিকার বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে থাকবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষকেরা এটা লঙ্ঘন করলে বোঝা যাবে। অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করলে শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’

অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ এসেছে যে এসব ব্যবহারিক কাজের জন্য প্রচুর জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে। কথাটা সঠিক, কারণ ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোর করিকুলামে দেখেছি অনেক ধরনের কাজ করতে হয়, জিনিসপত্র, ছবি, রং, বিভিন্ন আর্ট আইটেম জোগাড় করতে হয়। প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে ওয়ার্কশিট থাকে। অর্থাৎ মূল বই পড়ে শিক্ষার্থীরা জানবে এবং ওয়ার্ক বুক ধরে কাজ করবে ও প্রশ্নের উত্তর দেবে। লেখার চেয়ে ছবি আঁকা বেশি।

এতে অবশ্যই খরচ আছে। অনেক অভিভাবকের পক্ষেই এই বাড়তি খরচ জোগানো কঠিন হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন অভিভাবকের আয় নির্ধারিত হয়। তবে এটাও ঠিক যে শিক্ষার্থীকে যদি কোচিং করতে না হয় বা কম কোচিং করতে হয়, সে ক্ষেত্রেও কিছু টাকা বাঁচবে।

আমাদের দেশে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হতে-কলমে শিক্ষা বলতে নাইন-টেনে উঠে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাস ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের সেলাইয়ের ক্লাসকেই বুঝে থাকেন। তাই হঠাৎ করে সব বিষয়েই ব্যবহারিক সিস্টেম চালু হওয়ায় বেশ সংশয় দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। যেমন মুরগি পালন, ভাত বা স্যুপ রান্না, ফার্স্ট এইড, স্যালাইন বানানো, সোলার সিস্টেম বানিয়ে দেখানো, বাগান করা, বৃক্ষরোপণ ও গাছ বাঁচানো, রং করা, ডিজাইন করা, ঈদ কার্ড বানানো, বিষয়ভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা, গ্লোব থেকে দেশ খুঁজে বের করা পরিবারের কাজে হাত লাগানোসহ অনেক কিছু।

ছেলেমেয়ে সবার জন্য অনেক ব্যবহারিক কাজই কমন থাকছে। এই পদ্ধতিতে সবাইকে সব বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে, সবাইকে পড়াশোনায় অংশ নিতে হবে ও রেফারেন্স বই পড়তে হবে। বিষয়ভিত্তিক এ প্রক্রিয়ায় ভালো ছাত্রছাত্রী যা শিখবে বা যেভাবে শিক্ষাটা পাবে, পেছনের সারির ছাত্রছাত্রীরাও সেভাবে শিক্ষা পাবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম ভালো দিক হচ্ছে ছেলেমেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, জেন্ডার সমতার ধারণা দেওয়া ও পরিবারের কাজ যে সবার কাজ, এটা বলা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ, দেশের আর্ট, কালচার, ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, পরিবেশ পরিচিতি, সমাজবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ধারণাগুলো খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন অভিভাবকেরা খুব নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন এই নতুন শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে। কীভাবে আমরা এই বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি? কারণ, নয়া এই শিক্ষাপদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই এটাই প্রচলিত পদ্ধতি। এতে তাদের যদি কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে আমাদের হওয়াও উচিত নয়।

যেমন অভিভাবকদের একটি অংশ শিক্ষাক্রম বাতিল অথবা সংশোধন করে কিছু পরীক্ষা যুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। পরীক্ষা একেবারেই যে হবে না, তা কিন্তু নয়। পরীক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। নতুন নিয়মেও পরীক্ষা আছে, তবে সেটা তিন মাস পর পর নয়। প্রতিটি ক্লাসে, প্রতিটি অধ্যায় পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়ন করা হবে। ধারাবাহিকভাবে তা লিখে রেখে বছর শেষে নম্বর যোগ করে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, বোর্ড ও মাউশি কর্তৃপক্ষ এমনটাই বলছে সবাইকে। এই কথাটি অভিভাবকদের ডেকে স্পষ্ট করে জানানো গেলে ভালো হতো, অর্থাৎ তাঁদের আশঙ্কা দূর হতো এবং সবার মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হতো।

অধিকাংশ শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ পাননি বলে সমস্যা আরও বেড়েছে। কিছুসংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাওয়ায় বেশ সহজভাবে পড়িয়ে যাচ্ছেন। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন। অন্যদিকে যাঁরা এখনো প্রশিক্ষণ পাননি, তাঁরা নিজেরাও যেমন ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না পড়ানোর পদ্ধতিটি, সেই সঙ্গে অভিভাবকদেরও বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারছেন না। ফলে অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে।

আমরা সন্তানের লেখাপড়া বলতে ওদের ওপর বাড়তি চাপ দেওয়াকে বুঝি। সন্তানদের পিঠে থাকবে ঢাউস ব্যাগ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সারাক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে থাকা, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া, পড়া মুখস্থ করা, কোচিং করা আর জিপিএ-৫ পাওয়া। এর বাইরে আর তাদের কোনো জগৎ থাকতে নেই। কোন পরীক্ষায় কে, কত নম্বর পাচ্ছে, তাই নিয়ে অভিভাবকেরা আলোচনা করবেন। কেউ কম নম্বর পেলে তাকে হেনস্তা করা হবে, আর কেউ বেশি নম্বর পেলে তাকে হিরো বানানো হবে—এটাই আমাদের পড়াশোনার সিস্টেম। আমরা অভিভাবকেরা সন্তানের পড়াশোনার মধ্যে আনন্দটা খুঁজি না, খুঁজি শুধু সাফল্য ও প্রতিযোগিতা।

নতুন সিস্টেমে যে শিশু মন খুলে নিজের মতো করে তথ্য-উপাত্ত, প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারবে, এটাই তো একটি বড় অর্জন হওয়া উচিত। সুইস মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষক কার্ল গুস্তাভ জং বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সব অমঙ্গলের কারণ হলো এটাই যে মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারে না।’ ঠিক তাই ঘটেছে আমাদের শিশু-কিশোরদের জীবনে। এরা এমন এক প্রজন্মে পরিণত হয়েছে, যারা কথা বলার জন্য ভাষা জানে, গণিত শিখে, পদার্থবিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখে, এআই টেকনোলজি সম্পর্কে জানে, কিন্তু তাদের মনে বলার মতো কোনো কথা থাকে না, থাকে না-বলার মতো কোনো গল্প। আছে শুধু নিজের ইন্দ্রিয় উপভোগ, সম্পদ আহরণ, অভাব-অভিযোগ ও না-পাওয়ার কষ্ট।

স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। গত বছর মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশই স্কুলগামী। বারবার বলা হচ্ছে আনন্দহীন পড়াশোনা, ভালো ফল করার চাপ ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলেছে। ২০২৫ থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় পুরোদমে পরিবর্তন আনার আগে ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার যে স্কুলের শিক্ষার্থীরা কী চাইছে, হাতে-কলমে শিক্ষা? নাকি মুখস্থবিদ্যা?

  • শাহানা হুদা যোগাযোগকর্মী