চীনের অর্থনৈতিক বিস্ময় কি ফিকে হয়ে যাচ্ছে

চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পণ্য প্রস্তুতকারক দেশরয়টার্স

চীনে ‘জিরো-কোভিড’ নামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণে ২০২৩ সাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে একধরনের উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। গত বছরের শুরুতে জনগণের কেনাকাটার প্রবণতায় যে উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল, তাতে সেটিই মনে হচ্ছিল।

 কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই উজ্জ্বল ছবি দ্রুতই ফিকে হয়ে আসে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে রপ্তানি পড়ে যাওয়া, খুচরা বিক্রিতে স্থবিরতা নেমে আসা, করপোরেট মুনাফা সংকুচিত হয়ে যাওয়া, স্থানীয় সরকারের ব্যয়ে কাটছাঁট আনা এবং আবাসন খাতে মন্দা হাওয়া বয়ে যাওয়া—সব উচ্ছ্বাস-উল্লাসকে ম্লান করে দেয়।

চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর মানুষের আস্থা কমতে থাকে এবং বিদেশি ব্যবসায়ীরাও চীনের সঙ্গে ব্যবসা করতে ভয় পেতে শুরু করে। গত নভেম্বরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) চীন তার প্রথম ত্রৈমাসিক ঘাটতি রেকর্ড করেছে।

এরপরও চীনের অর্থনীতি সম্ভবত চলতি বছর কমপক্ষে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে এটি সম্মানজনক প্রবৃদ্ধি।

এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, চীনের অর্থনৈতিক ট্যাংকে এখনো প্রচুর জ্বালানি আছে। তার কাছে রেকর্ড উচ্চতায় সঞ্চয়ের হার আছে। মানে চীনের হাতে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের জন্য এখনো প্রচুর অর্থ রয়েছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিদ্যুচ্চালিত যান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো যে প্রযুক্তিগুলো আগামী দশকগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেবে, সেসব প্রযুক্তিতে ইতিমধ্যে চীন প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।

ফিউশন নিউক্লিয়ার, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন এবং ফোটোনিক সেমিকন্ডাক্টরের মতো উদীয়মান প্রযুক্তিতেও চীন ক্ষমতা দ্রুত বাড়াচ্ছে। এই কৌশল যে বেশ কার্যকর, তা অন্যান্য সফল অর্থনীতি থেকে আমরা জানতে পারি। যেমন ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে জাপান একইভাবে সফলতা পেয়েছিল।

তবে বাস্তবতা হলো, চীন প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে প্রতিকূল হাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনকে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ব থেকে বিযুক্ত করার যে চেষ্টা চলছে, তার ফলে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ বা এফডিআইকে নিরুৎসাহিত করছে এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম সরিয়ে আনতে উসকানি দিচ্ছে।

তবে অনেক বিদেশি কোম্পানি চীনকে পুরোপুরি ছেড়ে না গিয়ে ‘চায়না ‍+ ১’ (চায়না প্লাস ওয়ান) কৌশল অবলম্বন করছে। অর্থাৎ চীনে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম আগের মতো ঠিক রেখেই বিকল্প হিসেবে তৃতীয় কোনো দেশে নতুন কার্যক্রম শুরু করছে।

কারণটি খুব সোজা: বিশ্বের পণ্য প্রস্তুতকরণ খাতে মোট যত মূল্য সংযোজন হয়, তার ৩০ শতাংশ চীনের দখলে। অর্থাৎ জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে এই খাতে যে মূল্য সংযোজন করে, তা একাই চীন করে থাকে। পণ্য প্রস্তুতকরণ খাতে চীন এখনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে খরচ সাশ্রয়ের বিশাল সুবিধা দিয়ে থাকে।

সেই বিশাল অতিরিক্ত ক্ষমতা যোগ করে চীনের উৎপাদন খাত উন্নতি করতে থাকবে।

প্রকৃতপক্ষে, চীনকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে যুক্তরাষ্ট্র যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত একমাত্র একটি জিনিসই অর্জন করবে। সেটি হলো চীনকে বিদেশে তার নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে। ১৯৮০–এর দশকে জাপানের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনা ঘটেছিল।

দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির ওপর প্রতিকূল জনসংখ্যা ধারা বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে যেসব আলাপ তোলা হচ্ছে, সেটিও একইভাবে অতিরঞ্জিত। হ্যাঁ, এটি ঠিক, চীনের জনসংখ্যা বার্ধক্যপীড়িত হচ্ছে। নাগরিকেরা দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে।

অনেকে বলছেন, এটি চীনের অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দেবে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যেহেতু ক্রমবর্ধমান সংখ্যক কাজের স্বয়ংক্রিয়তাকে সক্ষম করে, সেহেতু চীনের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের শ্রমের চাহিদা কমে যাবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই ভারসাম্যহীনতা চীনের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

প্রথম দিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ, বেসরকারি কোম্পানি (যেমন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার) এবং স্থানীয় সরকারগুলোর নেওয়া বিশাল পরিমাণ ঋণ একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছিল।

কিন্তু এখন সেদিকে চীন নজর দিয়েছে। চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু শিখে থাকে, তা হলো, অতিরিক্ত অর্থায়ন একটি দেশের উৎপাদন খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

এ কারণেই চীনা কর্তৃপক্ষ বেসরকারি খাতে অতিরিক্ত অর্থায়ন বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

  • ইয়াং ইয়াও চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চের চেয়ার অধ্যাপক

  • ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট