উন্নয়ন নিয়ে আত্মতুষ্টি যে বিপদ আনতে পারে

উন্নয়নের সুবিধা সবাই পাচ্ছে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন
অলঙ্করণ: আরাফাত করিম

আত্মতুষ্টি মূর্খের লক্ষণ আর সংশয় হলো জ্ঞানীর লক্ষণ। আত্মতুষ্টি উন্নতির পথ বন্ধ করে দেয়। আর উন্নতির কোনো সীমারেখা থাকে না। কারণ, মানুষের মস্তিষ্ক অনন্ত শক্তির আধার। পক্ষান্তরে, কোনো কিছু বিশ্বাস বা গ্রহণ করার আগে পরীক্ষা করে দেখার নাম সংশয়, দর্শনশাস্ত্রে যা সংশয়বাদ নামে খ্যাত। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের দর্শন প্লেটোর লেখায় আমরা পাই: ‘অপরীক্ষিত জীবন যাপনের যোগ্য নয়’ অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জীবনও যাপন করা অনুচিত—এটা সক্রেটিস ও প্লেটোর অভিমত।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আচার্য হিসেবে বিশ্বভারতীর উত্তরায়ণে ছাত্রদের সঙ্গে একবার এক আলাপচারিতায় এক ছাত্র রাজীব গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘একবিংশ শতাব্দী বলতে কী বোঝেন, মি. গান্ধী?’ জবাবে রাজীব বলেছিলেন, ‘সবকিছু বাজিয়ে দেখা, পরীক্ষা করে দেখা। আর কোনো কিছু মুখ বুজে সহ্য না করার নাম একবিংশ শতাব্দী।’ অথচ নিজে একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে বিভিন্ন বক্তৃতায় বারবার প্রযুক্তি, প্রযুক্তি করায় মানুষ যখন বিরক্ত, তখন তাঁর মুখ থেকে আসা একবিংশ শতাব্দীর এমন সংজ্ঞা সবাইকে হতচকিত করে ফেলেছিল। আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার একেবারে শীর্ষের দিকেও প্রযুক্তিবিদের অনেক গল্প আমরা শুনি। বস্তুত, প্রযুক্তিবিদ হওয়া কঠিন কিছু নয়, কিন্তু সংশয়বাদী অতটা সহজ নয়।’

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প বলতে যাঁরা অভ্যস্ত এবং শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করাকে যাঁরা অপমানজনক মনে করেন, শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে সেই আমলা ও মন্ত্রীদের ধারণা কতটা স্পষ্ট? চলুন প্রথম শিক্ষার হার আর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিয়ে কথা বলি। অমর্ত্য সেন উন্নয়ন–সম্পর্কিত অধিকাংশ বক্তৃতায় ও লেখায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন। শিক্ষার হারের এমন উল্লম্ফন যে সম্ভব, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি সব সময় শ্রীলঙ্কার ও ভারতের কেরালার উদাহরণ টানেন। পক্ষান্তরে, জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য ব্যয়ে ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন এবং শিক্ষায় ২০১১ সালে সর্বনিম্নের সামান্য ওপরে। শিক্ষাব্যয়ে বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বরাদ্দ কমাচ্ছে, যদিও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হলো মানবসম্পদের ভিত্তি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে মাত্র ৭০ বছরে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তাকে উন্নয়ন বললে কম বলা হবে। এটাকে বলতে হবে উল্লম্ফন। যে লেনিন ক্ষমতায় আসলেন রাজনীতির মধ্য দিয়ে, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, সেই লেনিন ১৯২০ সালের ২২ ডিসেম্বর পার্টির কংগ্রেসে দীর্ঘ বক্তব্যের প্রথমেই বললেন, ‘লেস পলিটিকস ইজ বেস্ট পলিটিকস’ অর্থাৎ কম রাজনীতিই ভালো রাজনীতি। রাজনীতি নয়, আমাদের অর্থনীতিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। সে জন্য রাজনীতিবিদ নয়, সামনে নিয়ে আসতে হবে ইঞ্জিনিয়ার আর কৃষি অর্থনীতিবিদদের। বক্তব্যের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে ছিল সারা সোভিয়েতজুড়ে বিদ্যুতায়নের কথা। বললেন, ‘যে পর্যন্ত আমরা প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ না দিতে পারব আর শিল্প, কৃষি ও পরিবহন আধুনিক প্রযুক্তির ওপর দাঁড় করাতে না পারব, তত দিন আমাদের বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, তা বলা যাবে না।’ পরিশেষে লেনিন বললেন, ‘অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী দিয়ে এই বিদ্যুতায়নের কাজটি করা যাবে না। এ জন্য অতি দ্রুত আমাদের শতভাগ শিক্ষার হার অর্জন করতে হবে।’

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কায় ২০০০ সালেই বিদ্যুৎ প্রাপ্তির হার ছিল ৭০.২৬, যখন বাংলাদেশে মাত্র ৩২। ২০০৫, ২০১০, ২০১৬, ২০২০ সালে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কায় ও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির হার ছিল ৭৮.১৪, ৮৫.৩০, ৯৭.৫০, ১০০.০০ এবং ৪৪.২৩, ৫৫.২৬, ৭৫.৯২, ৯৬.২০। শিক্ষার হার শ্রীলঙ্কা ১৯৮১ সালেই অর্জন করেছে ৮৬.৭৮ যখন বাংলাদেশে মাত্র ২৯.২৩। শিক্ষার হারে ২০০১, ২০১৬ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের অর্জন ৯০.৬৮, ৯২.৩৯, ৯২.৩৮ ও ৪৭.৪৯, ৭২.৭৬, ৭৪.৯১। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি; কিন্তু আমরা শ্রীলঙ্কাকে ধরতে পেরেছি ২০০৫ সালে, যা বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে আবার কমতে শুরু করে। পক্ষান্তরে, শ্রীলঙ্কা নারীর ক্ষমতায়নের এই সূচক আজ পর্যন্ত বজায় রেখেছে। গড় আয়ুতে বাংলাদেশ ৭০-এর কোঠা স্পর্শ করে ২০১১ সালে আর শ্রীলঙ্কা তা অর্জন করে ১৯৯৯-এ। ২০২০ সালেও শ্রীলঙ্কার গড় আয়ু বাংলাদেশে চেয়ে ৫ বছর বেশি।

রাজাপক্ষে পরিবার ক্ষমতায় আসে ২০০৫। সে সময়ে দুর্নীতির মাত্রা শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশের স্কোরের ব্যবধান বেশি ছিল ১৫। ২০১০-এ ব্যবধান কমে হয় ৮, ২০১৫-তে ব্যবধান বেড়ে হয় ১২, ২০১৯ ও ২০২০-তেও ১২। বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ১৪৬তম আর শ্রীলঙ্কা ৯৪তম স্থানে। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত একটি প্রয়োজনীয় সূচক, কারণ, এটি অনেক কিছু নির্দেশ করে। এটি দুর্নীতি নির্দেশ করে, কারণ, ধনীরা কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয় আর টাকার বিনিময়ে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেন সরকারি আমলারা। আবার কর ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ধনীরা আরও ধনী হন কিন্তু গরিবের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার অর্থ জোগান দিতে পারে না রাষ্ট্র, ফলে বৈষম্য বাড়তে থাকে। বৈষম্য দূর করার জন্য নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক বিমা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, নিরাপত্তা বেষ্টনী ইত্যাদি প্রদান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই ব্যবস্থার সব কটিতেই শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সব সময়ই শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মাত্রার একটি সূচক বিশ্বব্যাংক ব্যবহার করে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টকে সরকারি দপ্তরের কাজ-কর্ম মেটানোর জন্য পুরো সময়ের কত অংশ ব্যয় করতে হয়—এভাবে মাপা হয় সূচকটি

আজকের এই নিবন্ধ লেখার পরিকল্পনা ছিল দুই থেকে তিন মাস আগের কিন্তু আমার শ্রীলঙ্কান বন্ধু, আনুশ উইজেসিনহার সঙ্গে কথা বলে, ভেতরের অবস্থা ভালো করে জেনে, বুঝে তাঁর দেশের সংকট নিয়ে লিখতে চেয়েছি। মাত্র দুই দিন আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো। লিডজ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ক্লাসে আমরা সহপাঠী ছিলাম। আনুশ এখন সিলন চেম্বার অব কমার্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ। শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য অনেকগুলো কারণ দুই দিনব্যাপী জুম মিটিং-এ তিনি আমার সামনে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থার সঙ্গে মিল আছে, এমন কয়েকটা এখানে উল্লেখ করা যাক: দুর্নীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক সংযোগ, ঋণের অর্থে ফ্যান্সি প্রজেক্ট তথা লোকদেখানো ও অনুৎপাদনশীল প্রকল্প ইত্যাদি।

বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সব সময়ই শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মাত্রার একটি সূচক বিশ্বব্যাংক ব্যবহার করে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টকে সরকারি দপ্তরের কাজ-কর্ম মেটানোর জন্য পুরো সময়ের কত অংশ ব্যয় করতে হয়—এভাবে মাপা হয় সূচকটি। এই সূচকের মান বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার দ্বিগুণ অর্থাৎ বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা শ্রীলঙ্কার দ্বিগুণ। যে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে মন্ত্রীদের দুর্নীতিতে সহায়তা করেন আমলারা। দুর্নীতির অর্থ পরস্পরের সঙ্গে ভাগাভাগি হয়। দুই পক্ষ মিলে এমন সব প্রকল্প হাতে নেন, যেখান থেকে অর্থ তছরুপ করার সুযোগ বেশি, তা যতই অনুৎপাদনশীল হোক না কেন। অনুৎপাদনশীল প্রকল্প ও রাজনৈতিক সংযোগ দুর্নীতিসংক্রান্ত গবেষণায় বিশাল অংশ জুড়ে আছে।

কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস তথা ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ করতে হয়। দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ ব্যয়ের মধ্যে রাখতে হবে। এভাবে বিশ্লেষণ করলে নিশ্চয়ই কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পে ব্যয়, সুবিধার চেয়ে অনেক বেশি হবে এবং প্রকল্প বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস কোর্সটি আমাদের পড়াতেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ক্রিস ন্যাস। এই গুরুর সঙ্গে এখনো আমার নিয়মিত যোগাযোগ। তাঁর অভিমত হলো, প্রকল্পের কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস করলেই চলবে না, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, প্রকল্পের ওয়েবসাইটসহ সর্বত্র পড়ার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দিতে হবে জনগণকে, বিশেষজ্ঞকে যাতে তাঁরা এর ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরতে পারে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প স্থানে সাইনবোর্ডে প্রতিটি জিনিসের মূল্য, শ্রমিক, কর্মকর্তা—সবার মজুরি বা বেতন প্রতিদিন লিখতে হবে। এভাবে দুর্নীতি কিছুটা হলেও দমন করা যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যথার্থ কস্ট-বেনেফিট অ্যানালাইসিস করা হয় কি না, তা আমার জানা নেই।

রাজনৈতিক সংযোগ দুর্নীতিরই অংশ। অসংখ্য জানা-অজানা রাজনৈতিক সংযোগ ও দুর্নীতি আমাদের শ্রীলঙ্কার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না—এই ‘বেদবাক্য’ আমরা ভুলে বসে আছি!

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail. com