বাখমুতে হেরে যাওয়ায় ইউক্রেনে কি রাজনৈতিক গোলমাল শুরু হচ্ছে?

নয় মাসের যুদ্ধে বাখমুতের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে

রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন ২০ মে ঘোষণা দেন ইউক্রেনের বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তাঁর সেনারা। তিনি আরও বলেন, ভাগনার গ্রুপ ২৫ মে রুশ সেনাবাহিনীর কাছে বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ বুঝিয়ে দেবে এবং তাদের সেনাদের বিশ্রাম ও প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাবে।

যুদ্ধ শুরুর আগে কৌশলগত দিক থেকে দোনেৎস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুতে ৭৫ হাজার মানুষ বসবাস করতেন। এটি ‘লবণ শহর’ নামে পরিচিত। সেখানকার মাটির নিচে বিশালাকার লবণের খনির মজুত আছে। প্রকৃতপক্ষে খনিটি সোলেদর শহরের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। গত জানুয়ারি মাসে রুশরা সোলেদরের দখল নেয়।

মদ উৎপাদনের জন্যও একসময় খ্যাতি ছিল বাখমুতের। কিন্তু রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার পর সেখান থেকে আঙুরের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাখমুতে ওয়াইনের ব্যবসায় ধস নামে। সড়ক ও রেল যোগাযোগের জন্যও বাখমুত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল।

আরও পড়ুন

সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া একটা খবরে জানা যাচ্ছে, বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া বাখমুত শহরেও কিছু নাগরিককে দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন ভাগনার গ্রুপের সেনারা।
বাখমুত জয়ের পর প্রিগোশিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মাতৃভূমি রক্ষায় এ সুযোগ ও উঁচু সম্মান দেওয়ার জন্য ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ।’ তিনি জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন ও মিখাইল মিজিস্টেভকেও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাদের কারণেই কঠিন এ অভিযান সম্ভব হয়েছে।

বিতর্কিত সামরিক ক্যারিয়ারের জন্য সুরোভিকিন ‘জেনারেল প্রলয়’ নামে পরিচিত। ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করার তিন মাসের মাথায় তাঁকে সেই পদ থেকে অপসারণ করা হয়। রাশিয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সুরোভিকিন। ভাগনার গ্রুপকে সহায়তা করার জন্য তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শহরাঞ্চলে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভাড়াটে এই বাহিনীটির দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সুরোভিকিন সিরিয়ার ইদলিব যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত (অনেকের কাছে কুখ্যাত)। সেই যুদ্ধে শহরটি ধ্বংস হয়েছিল।

এটাও আশ্চর্যজনক ঘটনা যে ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরের পতন যখন হচ্ছে তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জি-৭ সম্মেলন উপলক্ষে জাপানের হিরোশিমায় অবস্থান করছেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে তা হলো, কিয়েভে বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক গোলযোগ আসন্ন, যেটা দেশটির ও যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেবে।
আরও পড়ুন

জেনারেল মিখাইল মিজিস্টেভকেও ভাগনার গ্রুপের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁকে ‘মারিউপোলের কসাই’ বলা হয়। শহরটিতে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন মিজিস্টেভ। এর আগে সিরিয়ার আলেপ্পো যুদ্ধেও তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সহকর্মী সুরোভিকিনের মতোই মিজিস্টেভও আক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার কৌশল প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন।

রাশিয়ার দুজন সেনাপতিকে ভাগনার গ্রুপে নিয়োগ করার অর্থ হচ্ছে, ভাগনারকে এখন আর পুরোপুরি ব্যক্তিমালিকানাধীন সেনাদল বলা যাবে না। ভাড়াটে বাহিনীটি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অংশ হওয়ার পথে রয়েছে। প্রিগোশিন ভাগনার গ্রুপের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সামরিক কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

ভাগনার গ্রুপ বাখমুতে যে কৌশল প্রয়োগ করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন একই কৌশল প্রয়োগ করে সফল হয়েছিল। মারিউপোলের মতো বাখমুতের ক্ষেত্রে দেখা গেল শহর দুটিকে দখলে নেওয়ার পরিবর্তে শহর দুটিকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিয়েছে রুশ বাহিনী ও ভাগনার গ্রুপ।

বাখমুত জয় প্রিগোশিনের জন্য রাজনৈতিক বিজয়। অনেকে মনে করেন, পুতিনকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় বসতে চান প্রিগোশিন। সম্প্রতি পুতিনের প্রতি তাঁর ক্ষোভ তিনি উগরে দিয়েছিলেন। বাখমুতে ইউক্রেনীয়দের আক্রমণে তাঁর সেনাদলের একটি অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ায় তিনি পুতিনকে দায়ী করেছিলেন। এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ সামনের দিনগুলোতে তাঁর জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। ইতিহাস প্রমাণ দিচ্ছে, রুশদের রাজনীতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর।

আরও পড়ুন

বাখমুত যুদ্ধে দুই পক্ষের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যায়নি। শহরটি রক্ষায় ইউক্রেনীয়দের প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করেছেন প্রিগোশিন। বাখমুতের সিটাডেল অংশের পতনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয়ে ওঠে যে শহরটি রুশদের দখলে যাচ্ছে। এর আগে ভাগনারের সেনারা সেখানে ভয়াবহ হামলা চালায় ও রুশ বাহিনী ব্যাপক গোলা নিক্ষেপ করে।

বাখমুতের দালানকোঠাসহ প্রায় সব অবকাঠামো হয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরটি ছেড়ে যাওয়ার আগে ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশ কিছু ভবন উড়িয়ে দিয়ে গেছে, যাতে করে সেসব ভবনকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে রাশিয়া।

এটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয় যে রুশ বাহিনী এরপর কী পদক্ষেপ নিতে চলেছে। বাখমুত দখলের রাতেই রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি হিমার্স রকেটব্যবস্থাও তারা ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দাবি করেছে।

এরই মধ্যে রুশ বাহিনী বাখমুত ও চাসিভ ইয়ারের মাঝের সেতুগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সেতুগুলো দিয়েই বাখমুত ও এর আশপাশে ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে রসদ পৌঁছাত। এই সম্ভাবনা আছে, রুশ বাহিনী এখন নিপার নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে চায় সে জন্য চাসিভ ইয়ারকে পরবর্তী ভিত্তিভূমি করতে চায়। কিন্তু এর অনেকটাই নির্ভর করছে ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ অভিযান কী মাত্রায় চালায় তার ওপরে।

আরও পড়ুন

ইউক্রেনীয় সূত্র দাবি করছে, বাখমুত অগুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ৯ মাস দীর্ঘ যুদ্ধ চলার কারণ হলো, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামরিক নেতৃত্বের পরামর্শ তোয়াক্কা না করেই একা একা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

টেলিগ্রাম মেসেঞ্জারে একটি গুজব বেশ ব্যাপকভাবে চাউর হয়েছে যে ইউক্রেনীয় শীর্ষ সেনাপতি ভ্যালেরি জালুঝনি নিহত হয়েছেন। যদিও টেলিগ্রাম মেসেঞ্জারের বেশির ভাগটা নিয়ন্ত্রণ করে রুশ ব্লগাররা। এই গুজবের কারণ হচ্ছে, কয়েক দিন ধরে তাঁকে দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে না।

এটাও আশ্চর্যজনক ঘটনা যে ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরের পতন যখন হচ্ছে তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জি-৭ সম্মেলন উপলক্ষে জাপানের হিরোশিমায় অবস্থান করছেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে তা হলো, কিয়েভে বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক গোলযোগ আসন্ন, যেটা দেশটির ও যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেবে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সিনিয়র ফেলো সেন্টার ফল সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড দ্য ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউট
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত