তিস্তা চুক্তির দায়: মমতার নাকি মোদির

নরেন্দ্র মোদি

২০১৮ সালের ঘটনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিজেপি সরকারের চার বছরের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য নিয়ে কথা বলছিলেন দিল্লিতে। একপর্যায়ে তিস্তা চুক্তির অচলাবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারে আছি আরও এক বছর, তাই ব্যর্থ হয়েছি এখনই বলা যাবে না।’

সুষমা এদিন জানান, পশ্চিমবঙ্গ বলছে, তিস্তা চুক্তি হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই তারা তোরষা নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি দেওয়া যায় কি না, এমন বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। সুষমা জানিয়েছিলেন, এই প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সুষমার সেই সম্মেলনের পর আরও চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। তিস্তা নিয়ে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি, বিকল্প পানি সরবরাহ নিয়েও আর কিছু শোনা যায়নি। ১১ বছর আগে চুক্তির খসড়াও চূড়ান্ত হয়েছে, কিন্তু তিস্তা নদীর চুক্তি তারপরও হয়নি। কিছুদিন আগে ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে এটি এমনকি আলোচনার অ্যাজেন্ডাতেই স্থান পায়নি।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা এবং এই এলাকার পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা নদীর পানি একতরফা ভোগ করছে ভারত। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ভারত সাফ জানিয়ে দেয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজি হচ্ছেন না বলে চুক্তি করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের সরকার ১১ বছর ধরে এই ব্যাখ্যা মেনে নিচ্ছে। দেশে নদী ও পানি নিয়ে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু ভারতের এই অজুহাতকে চ্যালেঞ্জ করার গরজ কারও মধ্যে দেখা যায়নি। খতিয়ে দেখা হয়নি এই চুক্তিতে ভারতকে বাধ্য বা রাজি করানোর কী কী সুযোগ আছে বাংলাদেশের।

তিস্তা তো হয়নি, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি অনুসারে আর কোনো উল্লেখযোগ্য নদীর পানি ব্যবহার নিয়েও তাই কোনো চুক্তি হয়নি। এর মধ্যে ফেনী নদীকে ব্যবহার করে ভারতের স্বার্থে আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধির সমঝোতা হয়েছে।

যে কুশিয়ারার পানি ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ, তারই যৎসামান্য পরিমাণ চুক্তি মোতাবেক ব্যবহারের সমঝোতা হয়েছে কিছুদিন আগে। কিন্তু আসল যে কাজ, সেই তিস্তা বা বড় কোনো নদীর চুক্তি নিয়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।

এর দায় পশ্চিমবঙ্গের (মমতার) না, ভারতের কেন্দ্রীয় (মোদির) সরকারের।

২.

তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বলে এটি ভারতের একটি ইন্টারস্টেট বা আন্তরাজ্যীয় নদী। আবার এটি একাধিক দেশের ভেতর দিয়ে (ভারত ও বাংলাদেশে) প্রবাহিত বলে এটি একটি আন্তর্জাতিক নদীও।

ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বলে সেখানে সংবিধানে নদীর পানি ব্যবহার করার বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এখতিয়ার ঠিক করে দেওয়া আছে। সংবিধানের ২৪৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রণীত সপ্তম তফসিলে (তালিকা ২, ক্রমিক ১৭) বলা আছে, পানি সরবরাহ, সেচ, পানি প্রকল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য সরকারের এখতিয়ারভুক্ত, তবে তা শর্তাধীনে।

তালিকা ১-এর ক্রমিক ৫৬ অনুসারে এই শর্ত হচ্ছে, জনস্বার্থে পার্লামেন্টে এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে আন্তরাজ্য নদীর ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় সরকার তার নিয়ন্ত্রণাধীন করতে পারে। এই এন্ট্রি অনুসারে ১৯৫৬ সালে দুটো আইন করে নদী নিয়ে আন্তরাজ্য বিরোধ মেটানোর ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি ২০১৮ সালে আরেকটি খসড়া আইন করে আন্তরাজ্য নদী ব্যবস্থাপনার পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাও বিজেপি সরকার অব্যাহত রেখেছে।

তিস্তা আন্তরাজ্যীয় নদী বলে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুই করার নেই, এটা তাই ঠিক নয়। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, এটি আন্তর্জাতিক নদী বলে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করাটা পুরোপুরি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত, এখানে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য কোনো রাজ্যের বাধা দেওয়ার এখতিয়ার নেই।

সপ্তম তফসিলের তালিকা ১-এর ক্রমিক ১৪ অনুসারে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির বাস্তবায়নও সম্পূর্ণভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।

ভারত সরকার যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৭ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি ও শেখ হাসিনারই আমলে ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পাদন করে, তখনো পশ্চিমবঙ্গে বাধা ছিল।

প্রথমোক্ত চুক্তিতে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার গ্যারান্টি ক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল জাতিসংঘে কনসেনশাস স্টেটমেন্টের বাধ্যবাধকতার কথা বলে। দ্বিতীয় চুক্তিটি করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গকে সংকোশ নদ থেকে বিকল্প পানি সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে। ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে বর্তমান সরকার এ রকম কিছু সম্ভব করার তৎপরতা চালাতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

৩.

তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের অনীহার একটি বড় কারণ, এর ওপর পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলার সেচনির্ভরতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে আরও উজানে সিকিমে অনেকগুলো প্রকল্প ভারত সরকারের অনুমোদনে চালু হওয়ার কারণে তাঁরাই পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না।

ভারতের নদীসংযোগ প্রকল্প অনুসারে অন্য অনেক হিমালয়ান নদীর সঙ্গে তিস্তার পানিও অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর শুরু হলে পশ্চিমবঙ্গে পানির হাহাকার আরও বাড়তে পারে।

এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের পানি চাহিদার সমন্বয় করে ভারত এই সমস্যা প্রশমন করতে পারে। কিন্তু এই সমস্যা দূর হোক বা না হোক, এর পরিণতি বাংলাদেশ ভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তা চুক্তি না হওয়ার দায়ও ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যের হতে পারে না।

আমরা যদি এটি মেনে নিই, তাহলে ভারতের সঙ্গে অর্ধশতাধিক নদীর পানির ওপর আমাদের অধিকার কোনো দিন আদায় করা যাবে না। এসব নদীর প্রতিটি ভারতের কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত। ভারতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এসব নদীর পানি ব্যবহারের চুক্তির দায় অঙ্গরাজ্যের—এমন আত্মঘাতী কথা আমরা নিজেরাই বলি কোন বিবেচনায়?

৪.

তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগির আলোচনায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভুল কিছু নীতি অনুসরণ করে আসছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নদীর ‘পানি ভাগাভাগি’। নদী শুধু পানির আধার নয়, এটি বিশাল এক ইকোসিস্টেম, প্রাণবৈচিত্র্যের আবাসস্থল এবং আশপাশের এলাকার পরিবেশের নিয়ন্ত্রক। নদী তাই পানি ভাগাভাগির বিষয় নয়, এটি সমন্বিতভাবে ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার বিষয়।

ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর আলোচনা হয় কেবলই ‘পানি ভাগাভাগির’, সে-ও ভারতীয় ছকে। এই ছকে দুই দেশের আলোচনা হয় বাংলাদেশ ও ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের (পশ্চিমবঙ্গ) চাহিদার সমন্বয়ের। অথচ যেকোনো আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অনুসারে এটি হতে হবে বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রের চাহিদার সমন্বয়।

কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের আলোচনাটা হয় এমনভাবে যেন বাংলাদেশও ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, তার সঙ্গে ভারতের অন্য অঙ্গরাজ্যের পানি নিয়ে বিরোধ অভিভাবক হিসেবে ভারত নিষ্পত্তি করতে পারছে না শেষোক্ত রাজ্যটির অনীহার কারণে!

একটি স্বাধীন দেশের জন্য এটি অত্যন্ত অবমাননাকর বিষয়। ‘ভারতকে এত কিছু দিয়েছি যে তারা কখনো ভুলতে পারবে না’, এটি স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। এত কিছু দেওয়ার শর্ত যদি হতো বাংলাদেশেরও স্বার্থ রক্ষা, (যেমন অভিন্ন নদীর পানি দেওয়া, সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা বন্ধ করা), তিস্তা নদীর চুক্তি সম্পাদন, তাহলে এত বছর ঝুলে থাকার কথা নয়।

তিস্তা চুক্তি ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এখনো সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গকে কীভাবে রাজি করাবে, নাকি রাজি করানো ছাড়াই চুক্তি করবে, এটি ভারতের মাথাব্যথা, এই যন্ত্রণা আমাদের নেওয়ার দরকার নেই। আমাদের শুধু বলা প্রয়োজন ছিল, তিস্তার পানি না দিলে আমাদের থেকেও ভারত যেন কিছু আশা না করে।

সেটা এখনো বলা সম্ভব। ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের সাহায্য না চেয়ে বরং দেশের স্বার্থে ভারতের দায় নিয়ে সোচ্চার হলে তা এখনো সম্ভব।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ