আছে তো হাতখানি...

বন্ধুত্বফাইল ছবি

বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস আমাদের সবাইকে বন্ধুত্বের শক্তিকে মনে করিয়ে দেয়, সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেয় যে মানবতা আমাদের সবার এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমেই একটি শান্তিপূর্ণ ও সংযুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০১১ সালে জাতিসংঘ প্রথম ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে প্রতিবছরই পৃথিবীর বহু দেশে এ দিনটি নিয়মিতভাবে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসাবে পালিত হয়।

কাকে বলব বন্ধুত্ব—ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে? বেশ কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের আড্ডায় বন্ধুত্বের কথা উঠেছিল—উঠেছিল সেই সনাতন প্রশ্নও, কাকে বলব বন্ধুত্ব। একজন বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে হচ্ছে, যাকে সব কিছু বলা যায়। যেখানে কোনো রাখঢাক থাকে না। আরেক জন বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে হচ্ছে একদিন সারা দিন দেখা ও কথা বলার পরেও মনে হয়, দেখা বা কথা ফুরায়নি। কাল আবার দেখা আর কথা শুরু করতে হবে। তৃতীয় বন্ধুটি বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে একটি নির্ভরতার কাঁধ আর হাত, যে কাঁধে মাথা রাখা যায়, যে হাতে হাত রাখা যায়।

আমাদের এক তার্কিক বন্ধু বলেন, ও সবই কৈশোরের বা যৌবনের কথা। আজ পড়ন্ত বেলায় এসে আছে কি আমাদের সেই উদ্দাম বন্ধুত্ব? ওর কথা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে পড়লাম। মনে পড়ল দীর্ঘদিনের সেই বন্ধুটির কথা—৫০ বছরের সখ্য, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকেই। সে সময়ে আমাদের কথার কোনো চিহ্নিত পরিধি ছিল না—না বিষয়বস্তু সম্পর্কে, না সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আলোচনা চলত অনর্গল নানান বিষয়ে, তুঙ্গ বিতর্কে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তারুণ্যের ঝাপটায় আমরা তখন উদ্দীপ্ত।

তারপর আমাদের দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম পেশাগত বলয়ে, পারিবারিক জীবন নিয়ে। যৌবনের সে বন্ধুর সঙ্গে নিত্য দেখা হয় না, সাক্ষাৎ পাই মাঝেমধ্যে। মুখোমুখি দেখায় কিংবা দূরালাপনীতে খোঁজখবর নিই। আলোচনা আর যৌবনের বিষয়ে ফিরে যায় না, তারা এখন মোড় নেয় পেশাগত আশা-হতাশার বিষয়ে, ছেলে-মেয়েদের পড়া-শোনা সম্পর্কে। টের পাই পরিবর্তনটি।

দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কথাবার্তার ছায়াও অন্যদিকে সরে গেল। আমাদের কথোপকথনের আলো স্থির হয়ে থাকে ছেলে-মেয়েদের সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনিতে, নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ে। তারপর কেমন করে যেন কোন এক অমোঘ দিবসে আমরা আলোচনা শুরু করি কার কার শরীর ঠিক নেই, কে কে অসুস্থ, কে কে চলে গেল। ভাবলাম, জীবনের বদলের সঙ্গে সঙ্গে অর্ধশতাব্দীর বন্ধুত্বের মানুষটির সঙ্গে আমার কথোপকথন কেমন করে বদলে গেল। যেন একটি পূর্ণ বৃত্ত ঘুরে সেখানেই কথা বলা ফিরে এল, যেখানে চলে যাওয়াটাই মুখ্য আলোচনার বিষয়। বেশ কিছুদিন আগে সব কথা শেষ করে দিয়ে সে–ও চলে গেল।

পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, অঞ্চলে অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মূল ভিত্তিই তো ছিল এ আত্মিক বন্ধন। তাই খিদে পেলে পাড়ার যেকোনো বাড়িতেই পাত পেতেছি, মহল্লায় অন্যায় দেখলে যেকোনো বয়োজ্যেষ্ঠ যেমন যেকোনো বয়োকনিষ্ঠকে শাসন করেছেন, তেমনি অঞ্চলে বিপদ হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একসঙ্গে।

সম্বিত ফিরে পেলাম আমাদের দার্শনিক বন্ধুটির উচ্চারণে, চাণক্যের সেই চিরায়ত কথায়, ‘উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।’ হয়তো–বা; কিন্তু আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, বন্ধুতে বন্ধুতে সময় কাটানো হচ্ছে সাহচর্যের, আনন্দের ও সান্নিধ্যের। চূড়ান্ত বিচারে আমরা সে সাহচর্যের, আনন্দের আর সান্নিধ্যের হিরণ্ময় স্মৃতিটুকুই হৃদয়ে ধারণ করি, আর সব তুচ্ছ হয়ে যায়। ভালোবাসার সময়, মমতার সময়, গল্পের সময়, কাছে বসে থাকার সময়, নির্ভরতার সময়, আড্ডার সময়—এটাই বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি।

একজন বন্ধু আরেকজনের কাছে সময়টাই শুধু চায় নিজের কথা বলতে, বন্ধুর গল্প শুনতে, দুঃখ আর আনন্দ ভাগ করে নিতে; কিন্তু প্রায়ই এটা আমরা বিস্মৃত হই। আজকের যুগে বন্ধুকে আমরা ‘মুখোমুখি বসিবার’ সময়টুকুই দিতে পারি না। আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, আমাদের স্বার্থচিন্তা নিয়ে ‘আমি আমাকেই’ নিয়ে মত্ত—বন্ধুকে সময় দেব কখন। তাই বন্ধুত্বের বন্ধন ঢিলা হয়ে যায়, বন্ধুত্বের রং ফিকে হয়ে পড়ে, বাড়ে দূরত্বের মাইলফলক। সংযোগ হয়তো থাকে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে; কিন্তু হৃদয়ের যোগাযোগ?

আমাদের সমাজ অঙ্গনে বন্ধুত্বের সহমর্মিতা একসময় বড় দৃঢ় ছিল। সেই সব গল্প আমরা আজও শুনি—পারিবারিক বলয়ে একটি শক্ত সহমর্মিতার বন্ধনে মানুষ ভালোবাসা, মায়া আর মমতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। বৃহত্তর পরিবারে সে বন্ধন, সেই একাত্মতা ছড়িয়ে গিয়েছিল এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। ঝগড়াঝাঁটি কি ছিল না, ছিল না কি মনোমালিন্য? অবশ্যই ছিল; কিন্তু তা সহমর্মিতার ওই মানবিক বন্ধনকে নষ্ট করতে পারেনি। দিনের শেষে মানুষ ওই পারিবারিক সৌহার্দ্যের কাছেই মানুষ ফিরে গেছে হাসিতে-আনন্দে, দুঃখ-কষ্ট, বিপদে-আপদে। পরিবারই তো ছিল মানুষের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।

সময়ের সুতায় আমাদের সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের দুই ধরনের সম্পর্ক ছিল— একটি আত্মিক, একটি ব্যবসায়িক। আত্মিক সম্পর্কটি ছিল বন্ধুত্বের ও সৌহার্দ্যের; ব্যবসায়িক সম্পর্কটি কাজের; আত্মিক সম্পর্কটি মমতা ও মানবিকতার, ব্যবসায়িক সম্পর্কটি অর্থের ও স্বার্থের। ব্যবসায়িক সম্পর্কে লাভ-অলাভের কথা উঠেছে, অংশ-ভগ্নাংশ নিয়ে বিতর্ক চলেছে, চুলচেরা হিসাব-নিকাশ কষা হয়েছে; কিন্তু দিনের শেষে এ সবকিছু ছাপিয়ে অখণ্ড সত্য হিসেবে সর্বদাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

বন্ধুরা মিলে ঘুড়ি ওড়ানো শেষে বাড়ি ফেরা। খুলনার বিএল কলেজ মাঠ।
ছবি: রিয়াদ হোসেন

এ আত্মিক সম্পর্কের কারণেই আমরা একে অন্যের স্বজন হয়ে উঠেছিলাম। নির্দ্বিধায় বয়োজ্যেষ্ঠদের ‘কাকা, খালা, পিসি, দাদা, আপা’ ইত্যাদি সম্বোধনে বরণ করেছি। এর মাধ্যমেই গড়ে তুলেছি এক আত্মীয়তার বন্ধন, যার কাছে হার মেনেছে কত রক্তের সম্পর্কও। একইভাবে বয়োকনিষ্ঠদেরও কাছে টেনে নিয়েছি কত নামে।

পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, অঞ্চলে অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মূল ভিত্তিই তো ছিল এ আত্মিক বন্ধন। তাই খিদে পেলে পাড়ার যেকোনো বাড়িতেই পাত পেতেছি, মহল্লায় অন্যায় দেখলে যেকোনো বয়োজ্যেষ্ঠ যেমন যেকোনো বয়োকনিষ্ঠকে শাসন করেছেন, তেমনি অঞ্চলে বিপদ হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একসঙ্গে।

আমাদের মমতার উৎস ছড়ানো ছিল চারদিকে। স্কুল ছুটির পর টইটই করে বেলা ২টার জায়গায় বিকেল ৪টায় ঘরে ফিরলে মা ভাত বেড়ে দেননি, দিয়েছেন রহিমন বুয়া। প্রবল বৃষ্টিতে যখন হইহই করতে করতে বাড়ি ফিরছি, তখন তাঁর দোকান থেকে দেখতে পেয়ে মাথায় ছাতা ধরেছেন অশ্বিনী কাকা। বর্ষার জলধারার মতো তাঁর বকাঝকাও চলেছে স্রোতের মতো। যখন বাড়ি পৌঁছি, তখন আমার শরীরে একফোঁটা জলের স্পর্শ লাগেনি, কিন্তু হাঁপানির রোগী অশ্বিনী মিস্ত্রির সারা শরীর ভিজে জবজবে।

স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষা। পাড়ার নিতাই মাস্টারমশাই প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে পড়িয়ে যান অঙ্কে কাঁচা পলাশকে। কেউ তাঁকে এটা করতে বলেনি। নাজমা আপার মায়ের শরীর খুব খারাপ—নিয়ম করে খাবার আসছে নানান বাড়ি থেকে। পালা করে রাত জাগছি আমরা, সব কাজ ফেলে মোড়ের ডাক্তার চাচা খালাম্মার শিয়রে তিন দিন ধরে। মহল্লায় শিশিরের বোন কণাদির বিয়ে। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই খাটছি তার পেছনে—বোঝার উপায় নেই, কে কণাদির ভাই, কে কাকা আর কেইবা মাসি। আত্মিক এসব মমতার, বন্ধুত্বের, সহমর্মিতার, অধিকারের সম্পর্ক ছিল শর্তবিহীন। সেখানে লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসেনি, দেনা-পাওনার হিসাব ওঠেনি, স্বার্থবুদ্ধি মাথাচাড়া দেয়নি। এসব সম্পর্কের ভিত্তি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, পারস্পরিক ভালোবাসা এবং নিবিড় একাত্মতা।

তাই বলে সমাজে কি অসমতা ছিল না সম্পদের, বিভাজন ছিল না কৌলীন্যের, ভেদাভেদ ছিল না ধর্মের? নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু ছিল না সম্পদের এমন উলঙ্গ প্রদশর্নী, কৌলীন্যের এমন চোখধাঁধানো ভঙ্গি, ধর্মের এমন উন্মাদনা। আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ আর মানবিকতাই বড় হয়ে উঠত।

আজ কেন যেন মনে হয়, সমাজের ভেতরে-বাইরে মানুষে মানুষে ব্যবসায়িক সম্পর্কটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে—গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক। আমরা আমাদের বড় নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছি, বৃত্ত গড়ে তুলছি গুটিকয়েক মানুষকে নিয়ে, যাঁদের আমাদের প্রয়োজন হবে স্বার্থের কারণে। ভাবছি, এতেই আমাদের সমৃদ্ধি, এতেই আমাদের পুষ্টি, এতেই আমাদের নিরাপত্তা। সমাজে আমরা তাই আজ বড় বিভক্ত, বড় বিভাজিত। বন্ধুত্ব নয়, সংঘাত; ভালোবাসা নয়, সহিংসতা; মমতা নয়, নৃশংসতা আজ আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছ।

ঠিক একই ভাবে সংঘাত আর সহিংসতা আজ বৈশ্বিক ব্যবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আজ সংঘাত দেশে দেশে, সহিংসতা আজ দেশের ভেতরে। একটি দেশ আরেকটি দেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, একটি দেশ আরেকটি দেশ দখল করে নিতে চাইছে। কোটি কোটি মানুষ আজ দেশহারা, গৃহহারা। সবাই সবাইকে গণ্য করছে মিত্র হিসেবে নয়, শত্রু হিসেবে। জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিশ্বভ্রাতৃত্ব আজ মনে হচ্ছে কতকগুলো শব্দ, একগুচ্ছ মূল্যবোধ নয়। বিশ্বশান্তি যেন একটি অলীক বস্তু, ‘শান্তির বাণী আজ নিভৃতে কাঁদে।’

তবু আশা রাখি। আশা রাখি মানুষে, বন্ধুত্বে; ভ্রাতৃত্বে, সৌহার্দ্যে; স্থিরতায় ও শান্তিতে। আজ বিশ্ব বন্ধু দিবসে বন্ধুত্বের হাতটি বাড়াতে চাই সবার প্রতি। বলতে চাই, ‘আছে তো হাতখানি’।

  • সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

*মতামত লেখকের নিজস্ব