বাসে আগুন দিয়ে ঘরে ফিরে সন্তানকে স্পর্শ করেন কীভাবে

‘এত সিসিটিভি, এত আড়িপাতার যন্ত্র, এত নজরদারি, এত গোয়েন্দা কার্যক্রম, এর মধ্যে রোজ এতগুলো বাস কে এসে পোড়ায়!’

এই সব কী! রোজ বাসে আগুন দিচ্ছেন কেন? কখনো কখনো যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে, কখনো-বা ভেতরে ঘুমন্ত বাসের চালক বা সহকারীকে রেখে রোজ বাসে আগুন দেওয়ার মানে কী! কী অর্জন করতে চাইছেন এসব থেকে!

এতে কী ফল আসে? দয়া করে বাসে আগুন দেওয়া বন্ধ করুন। আর এটা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। ‘ওরা অগ্নিসন্ত্রাসী’, ‌‘ওরা বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারে’—এসব কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। যারা অগ্নিসন্ত্রাসী তাদের নিবৃত্ত করতে পারেন না কেন!

দয়া করে চোখ-কান খোলা রাখুন, শুনুন, মানুষ কী বলে! মানুষের পারসেপশন কী! জগৎ চলে পারসেপশন বা ধারণা দিয়ে! আসলে কে বাস পোড়ায়, কোন বাসটা কে পুড়িয়েছে, তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দেশের মানুষ কী মনে করে, দেশের মানুষ বাস পোড়ানোর জন্য কাকে দায়ী করে থাকে।

এত সিসিটিভি, এত আড়িপাতার যন্ত্র, এত নজরদারি, এত গোয়েন্দা কার্যক্রম, এর মধ্যে রোজ এতগুলো বাস কে এসে পোড়ায়! অশরীরী আত্মারা এসে আগুন দিচ্ছে বাসে? ধরতে পারেন না? বাসে আগুন দেওয়ার আগেই তাদের হাতেনাতে ধরুন। বাসে আগুন দেওয়ার সময় ধরে দেখিয়ে দিন, এরা বাস পোড়ায়। তাদের যারা নির্দেশ দেয়, তাদের ফোনালাপ আদালতে শোনান, এই দেখুন, এই অগ্নিসন্ত্রাসী নেতা বা হোতা কীভাবে হুকুম দিচ্ছে বাস পোড়ানোর!

নীতিনির্ধারকদের বলব, দয়া করে বাগদাদের খলিফাদের মতো ছদ্মবেশে মানুষের মধ্যে যান এবং একটাবার মানুষের পারসেপনশনটা বোঝার চেষ্টা করুন। অগ্নিসন্ত্রাসীরা যদি বাস পোড়ায়, তাদের নিবৃত্ত করতে না পারার দায় সরকারের, কর্তৃপক্ষের, রাজনীতির ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। তারা কেন বাস পোড়ানোর ঘটনা রোধ করতে পারে না?

এত সিসিটিভি, এত আড়িপাতার যন্ত্র, এত নজরদারি, এত গোয়েন্দা কার্যক্রম, এর মধ্যে রোজ এতগুলো বাস কে এসে পোড়ায়! অশরীরী আত্মারা এসে আগুন দিচ্ছে বাসে? ধরতে পারেন না? বাসে আগুন দেওয়ার আগেই তাদের হাতেনাতে ধরুন। বাসে আগুন দেওয়ার সময় ধরে দেখিয়ে দিন, এরা বাস পোড়ায়। তাদের যারা নির্দেশ দেয়, তাদের ফোনালাপ আদালতে শোনান, এই দেখুন, এই অগ্নিসন্ত্রাসী নেতা বা হোতা কীভাবে হুকুম দিচ্ছে বাস পোড়ানোর!

আরেকটা কথা, বিএনপি অবরোধের ডাক দিয়েছে। অবরোধ মানে হরতাল নয়! অবরোধ করতে হলে শারীরিকভাবে একটা জায়গায় গিয়ে অবস্থান নিতে হবে। রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করতে হলে রাজপথে, রেলপথে গিয়ে বসে পড়তে হবে। কোথাও কোনো সমাবেশ দেখি না। তাহলে তো এটা হরতাল হয়ে গেল!

হরতালের মানে জানতাম, গাড়ির চাকা ঘুরবে না, দোকানপাট খুলবে না, অফিস আদালত চলবে না। সেই হরতাল তো আর নেই। থাকুক, চাইও না। কিন্তু অবরোধ মানে নেতা-কর্মীদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও জড় হতে হবে। কোনো সমাবেশ তো দেখি না। খালি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কিংবা ফেসবুকে ভিডিওবাণী দিয়ে কর্মসূচি দিলে তো হবে না। গায়েগতরে খাটতে হবে।

আর অবরোধ মানে কী, কোন রাস্তায় বের হতে পারব, দোকানপাট খুলতে পারব কি না, অফিস-আদালত যেতে পারব কি না, এটা অবরোধ-কর্মসূচির ডাক দেওয়া রাজনৈতিক দল ও নেতাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। অবশ্য বিএনপি পাঁচ বছর আগে যে অবরোধ দিয়েছিল, সেটাই তো এখনো প্রত্যাহার করে নেয়নি।

বিএনপি বলতে পারে, জড়ো যে হব, হবটা কী করে, এত গ্রেপ্তার, এত দমন-পীড়ন! প্রায় ১০ হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। মামলার পর মামলায় নেতাদের জীবন বিপর্যস্ত। অবশ্যই জুলুম-পীড়নের নিন্দা করি। তবে একটা কথা বলি, যদি মনে করেন, আপনাদের দাবি ন্যায়সংগত, তা আদায় করতে হলে ত্যাগ স্বীকার তো আপনাদেরই করতে হবে।

আপনি যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন, তারা ফুল নিয়ে আপনাদের বরণ করে নেবে আর পায়েস খাওয়াবে, এ রকম ভাবলে তো আন্দোলন হয় না।

আন্দোলন সফল না হওয়ায় হাল ছাড়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘আমি এটাই বলব যে তাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত। দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরুন, এই আন্দোলন সফলতার জন্য কত দীর্ঘ সময়ের সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল।তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়ে আপনি যদি প্রতিবারই আপনার প্রচেষ্টার হাল ছেড়ে দেন, তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে, আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ সংগ্রাম।...নাছোড়বান্দা হওয়া ছাড়া এযাবৎ কোনো আন্দোলনই সফলতার আলোর মুখ দেখেনি।’ (নোয়াম চমস্কির সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চাভিলাষ। অনুবাদ রফিকুল রনি। প্রকাশক নাগরী)

সহিংস আন্দোলন আজকের দিনে সফল হয় না। মানুষের ব্যাপক সমাবেশ হলো একমাত্র উপায়। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র সফল হয়েছেন অহিংস আন্দোলন করে, নেলসন ম্যান্ডেলা বা গান্ধীজিও। কাজেই বিএনপি বা বিরোধীদের শতভাগ চেষ্টা করে যেতে হবে আন্দোলন অহিংস রাখার। কোনো ফাঁদেও যেন তারা পা না দেয়।

আর সরকারের কাজ হবে আজ থেকেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে একটা বাসেও আর আগুন না জ্বলে। একটা গাড়িও ভাঙচুর না হয়। একটা স্থাপনাও আক্রান্ত না হয়। নাগরিকদের এই ন্যূনতম নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। বাস জ্বলবে, আর তার ছবি দেখিয়ে বলা হবে, ‘ওই দেখো, ওরা অগ্নিসন্ত্রাসী’—এই কৌশল বুমেরাং হতে বাধ্য। যারা বাস পোড়ায়, তাদের আগে-ভাগে থামিয়ে দেওয়াই সরকারের দায়িত্ব।

রাজনীতির খেলা, ক্ষমতার লড়াইয়ের বলি হয়ে যখন নিরীহ বাসশ্রমিক জীবন্ত দগ্ধ হয়ে আপন কর্মস্থল বাসের ভেতরে মারা যান, সেই খবর মানতে পারি না। বাসের মালিকেরা পোড়া বাসের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদেন, বিলাপ করেন, দেখে নিজের বুক জ্বলে যায়। আপনারা যারাই বাসে আগুন দেন তাঁদের বিবেক কি একটুও নড়ে না! বাসে আগুন দিয়ে ঘরে ফিরে আপনারা সন্তানকে আদর করেন, মাকে মুখ দেখান! দেখাতে পারেন! আপনাদের বিবেক বলে কি আসলেই কিছু আছে!

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক