ইউক্রেনের নতুন কৌশলে রাশিয়া কতটা ধরাশায়ী হলো

ইউক্রেনের হামলায় বিধ্বস্ত রাশিয়ার ট্রেনছবি : রয়টার্স

রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের হামলার পর কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে জিততে চলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্র এই আক্রমণ নিয়ে শিরোনাম করেছে ‘রাশিয়ার পার্ল হারবার’। এটা বিস্ময়করই। কেননা এই আক্রমণের চূড়ান্ত পরিণতি কী হতে পারে, সেটা তারা ভুলে গেছে।

বাস্তবে মাঠের যুদ্ধের চিত্র হলো রাশিয়ার দিকেই ক্রমে পাল্লা ভারী হচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।

সর্বশেষ ড্রোন হামলা ইউক্রেনের নতুন কৌশলের ইঙ্গিত দেয়। রাশিয়ার যুদ্ধের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়ে হয় মস্কোর কাছ থেকে আরও সুবিধাজনক চুক্তি আদায় করা, অথবা সম্ভবত আমেরিকা ও ইউরোপীয় মিত্রদের সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে রাজি করানো।

ইউক্রেনের এই নতুন কৌশলের শুরু ২০২৪ সালের আগস্টে কুরস্কে হামলার মধ্য দিয়ে। ওই অভিযানে ইউক্রেনের প্রায় ৭৫ হাজার সেনা নিহত বা আহত হয়েছিলেন। একই সময়ে ইউক্রেন রুশ ভূখণ্ডের ভেতরে ড্রোন হামলা শুরু করেছিল।

আরও পড়ুন

এই হামলাগুলো রাশিয়ান বাহিনীকে বাধ্য করে তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে। তারা ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে যুদ্ধ চালাতে শুরু করে, যাতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমে। এতে রুশ সেনাবাহিনীর অভিযানও কিছুটা মন্থর হয়।

অন্যদিকে রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশল হচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলা। সম্ভব হলে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘিরে ফেলে তাদের রসদ ও সেনা সরবরাহের পথ কেটে ফেলা। রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে কিংবা কুরস্কের মতো ব্যয়বহুল সামরিক যুদ্ধে টেনে আনার পরও ইউক্রেন রাশিয়াকে তার সামরিক লক্ষ্য থেকে খুব একটা বিচ্যুত করতে পারেনি।

বর্তমানে, রাশিয়ান বাহিনী তাদের সামরিক অভিযান সুমি প্রদেশে সম্প্রসারিত করেছে। এটি কুরস্কের পাশেই অবস্থিত। রাশিয়া যদি কুরস্কে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারে এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা আরও দুর্বল করতে পারে, তাহলে সুমি হয়ে কিয়েভের দিকে স্থলপথে হামলার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

রাশিয়ার সামরিক ব্লগাররা মনে করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন যদি কোনো ‘শান্তিচুক্তি’ করেও তারপরও রুশ ভূখণ্ডে ইউক্রেনের গেরিলাদের ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর আক্রমণ অব্যাহত থাকবে।

ইউক্রেনের সম্প্রতিক হামলা রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্বের ওপর—বিশেষ করে ক্রেমলিন, রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর ওপর—কী প্রভাব ফেলবে, তা অজানা। রাশিয়ানরা তাদের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন আনবে, অন্তত তেমন কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না।

তারা মনে করেন যে ন্যাটো আগামী বহু বছর ধরে রাশিয়ার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে যাবে—যদি না রাশিয়া আরও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে তাদের দমন না করে।

ইউক্রেন কীভাবে তাদের কৌশল বাস্তবায়ন করছে, তার কিছু উদাহরণ এখন স্পষ্ট। রুশ বিমানঘাঁটিগুলোর ওপর হামলা শুধু কৌশলের একটি অংশ। রেলপথে হামলা হয়েছে, রেলসেতু ধ্বংস করা হয়েছে এবং কের্চ প্রণালির সেতুতে বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র তারা ধ্বংস করেছে। ইউক্রেন দেখাতে চায় ওই অঞ্চলগুলোর ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ খুব একটা কার্যকর নয়।

ইউক্রেন রেকর্ডসংখ্যক গুপ্তহত্যাও চালাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৪ বছর বয়সী সাবেক একজন মেজরও রয়েছেন রাশিয়ার দক্ষিণের স্তাভরোপোলে এক বিস্ফোরণে তিনি নিহত হন।

ইউক্রেন রাশিয়ার বড় একটি দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে। সেই দুর্বলতাটি হলো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুরক্ষার অপ্রতুল প্রস্তুতি। রাশিয়ার গোয়েন্দা তথ্যও খুব দুর্বল।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন সুবিধাজনক জায়গায় থাকার মূল জায়গাটা হলো, তাদের বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা পাচ্ছে। এই সুবিধাটার কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সুসমন্বয় দেখা যাচ্ছে। একসঙ্গে ইউক্রেনের অপ্রচলিত সামরিক কার্যক্রমের সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর পাশাপাশি, ইউক্রেনের নিজস্ব ড্রোন উৎপাদন, ইলেকট্রনিকস ও সফটওয়্যার উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরাও রয়েছে। রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউক্রেনের সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা দেশের বাইরে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর হয়ে কাজ করছিলেন। এমনকি ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোও ইউক্রেনীয় সফটওয়্যার উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিয়েছিল, যাতে ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রযুক্তি সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করা যায়।

ইউক্রেনীয়দের কৌশলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথমত, ড্রোন ব্যবহারের কৌশলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এর সঙ্গে রাশিয়ার বাহিনী বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। ড্রোন হামলা রাশিয়ানদের গতি কিছুটা ধীর করে দিলেও তাদের থামানো যায়নি।

এর বিপরীতে, রাশিয়ারা এখনো ইউক্রেনীয়দের ওপর ব্যাপক চাপ বজায় রাখতে পারছে। তারা দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং এফএবি বোমা ব্যবহার করে চলেছে।

ইউক্রেনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু গ্লাইড বোমা পেয়েছে, তবে এগুলোর বিস্ফোরক বহনের ক্ষমতা রাশিয়ার ব্যবহৃত গ্লাইড বোমার তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া, এই বোমা নিক্ষেপের জন্য ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানের সংখ্যাও কমে আসছে। ইউক্রেনের গ্লাইড বোমা ২৫০ পাউন্ড পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়ার গ্লাইড বোমা ৫৫৫ পাউন্ড থেকে শুরু করে প্রায় ৩ টন পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে। সেগুলো নিক্ষেপের পর ৩৭ মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম।

আরও পড়ুন

এটা নিশ্চিত যে ইউক্রেনীয়রা তাদের সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন। বিশেষ করে তাদের বাহিনীগুলো একটি দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে চলা সংঘর্ষে ছড়িয়ে রয়েছে। রাশিয়া এখন সুমি অঞ্চলে অভিযান শুরু করার যুদ্ধফ্রন্ট আরও সম্প্রসারিত হলো।

ইউক্রেনের জন্য আরেকটি সমস্যা হলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পর্যাপ্ত যুদ্ধ সরঞ্জামের জোগান নিশ্চিত করা এবং আমদানি করা অস্ত্র পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা। ইউরোপ এখন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কেননা, ইউরোপের নীতিকৌশল প্রণেতারা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে তাদের নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট সম্পদ তাদের কাছে নাই।

এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে কি না। এর কারণ হলো, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। ফলে অঞ্চলটিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, যুক্তরাষ্ট্র তার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ ফাঁকা করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দেয় তাহলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী খুব বেশি দিন যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারবে না।

ইউক্রেনের মূল সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক।

ইউক্রেনের বর্তমান নেতৃত্ব রাশিয়াকে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে রাজি নয়। ইউক্রেনের বর্তমান নেতারা হয়তো একটি স্থিতাবস্থাভিত্তিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারে। কিন্তু রাশিয়া এখনো সেটি মেনে নিতে রাজি নয়।

অন্যদিকে আমরা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব সামান্য জানি। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। নিজেদের নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন তারা করতে পারেনি।

ইউক্রেনের সম্প্রতিক হামলা রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্বের ওপর—বিশেষ করে ক্রেমলিন, রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর ওপর—কী প্রভাব ফেলবে, তা অজানা। রাশিয়ানরা তাদের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন আনবে, অন্তত তেমন কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না।

সব দিক বিবেচনায়, ইউক্রেনের নতুন কৌশল যুদ্ধের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।

  • স্টিফেন ব্রায়েন এশিয়া টাইমসের বিশেষ সংবাদদাতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী (নীতিবিষয়ক)।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

আরও পড়ুন