শেষ পর্যন্ত হজের মতো ধর্মীয় বিষয়ও সরকারের ব্যবসায়িক নজরের বাইরে যেতে পারল না। সরকার টাকার সংকটে আছে। এর মধ্যে আইএমএফ রাজস্ব তথা সরকারের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য চাপ দিয়েছে ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে। যে কারণে সরকার বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এবারের হজ প্যাকেজে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। ফলে হজ পালনও সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
হজ করতে এবার কোরবানিসহ প্রায় সাত লাখ টাকার মতো খরচ হবে। কোরবানি বাদে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৮৩ হাজার ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয় হবে। অথচ এই জানুয়ারিতেও ১৫ দিনের ওমরাহ প্যাকেজের খরচ ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই টাকায় বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনায় আবাসন, মক্কা-মদিনা যাতায়াত ও খাবার যুক্ত ছিল।
হজের সময় চাহিদা বেশি থাকায় খরচ বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু চার, পাঁচ গুণ বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। উপরন্তু এবার হজ উপলক্ষে সৌদি সরকার বিভিন্ন ফি কমিয়েছে। ওমরাহ ও হজের জন্য কোনো ভিসা ফি লাগবে না। সৌদি আরবের হজ ও উমরাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই বিষয় স্পষ্ট করে বলা আছে। এরপরও আমাদের সরকার হজের খরচ বাড়িয়েছে।
এবারের প্যাকেজে বিমানভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। হজের বিশেষ ফ্লাইটে যাত্রীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু তাই বলে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিমানভাড়া বেশি বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনসের ছাড়াও অন্যান্য একাধিক বিমান সংস্থাকে হজযাত্রী পরিবহনে যুক্ত করা প্রয়োজন। তাহলে বিমানভাড়া কমে আসতে পারে।
মক্কা-মদিনায় আবাসনের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার টাকা। হজের পাঁচ দিন সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে রয়েছে মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু, বিছানা ও খাবার। ভিসা ফি আট হাজার টাকা। মক্কা, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনা, মক্কা যাতায়াতের জন্য উন্নতমানের বাসভাড়া ধরা হয়েছে ১৯ হাজার টাকা। এই হচ্ছে হজের উল্লেখযোগ্য খরচ।
কিন্তু খরচগুলো বেশ অসংগতিপূর্ণ। বিষয়টি বিস্তারিত জানতে সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশি ও একাধিকবার হজ করেছেন—এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সর্বনিম্ন স্তরের প্যাকেজের আওতায় হজের সময় সাধারণ ভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সর্বনিম্ন হজ প্যাকেজে নিশ্চয়ই পাঁচ তারকা হোটেল বা উন্নতমানের হোটেলে রাখা হয় না। সাধারণ ভবনে রাখা হলে খরচ কম হওয়ার কথা। ২ লাখ ৪ হাজার টাকা আবাসন খরচ হলে সৌদি মুদ্রায় লাগবে আনুমানিক ৭ হাজার ২০১ রিয়াল। হজের জন্য একসঙ্গে অনেক বাড়ি বা এপার্টমেন্ট ভাড়া করা হয় প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ দিনের জন্য। এ হিসাবে খরচ আরও কম পড়ার কথা।
এ কথা ঠিক যে, এ বছর টাকার বিপরীতে সৌদি রিয়ালের দাম বেড়েছে। গত বছর হজের সময় সৌদি রিয়ালের দাম ধরা হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা। কিন্তু তারপরও এবারের খরচবৃদ্ধি কোনো মাণদণ্ডে যৌক্তিক হয়নি।
আমাদের দেশে কার্যত সর্বত্রই সীমাহীন লুটপাট চলছে, যে যেভাবে পারছে, লুটে নিচ্ছে; কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই; সেহেতু হজের এই অস্বভাবিবক খরচ বৃদ্ধির নেপথ্যে যে রাজনৈতিক শক্তির মদতপুষ্ট শ্রেণির অতিমুনাফালোভী গোষ্ঠীর হাত আছে, সে ধারণা করাই যায়। এ কারণেই সৌদি সরকার হজের বিভিন্ন খরচ হ্রাসের যে ঘোষণা দিয়েছে, তার প্রতিফলন হজ প্যাকেজে নেই। সৌদি সরকার ব্যয় হ্রাসের ঘোষণা না দিলে হয়তো এই বছর হজ প্যাকেজের মূল্য ১০ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকত।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গত সাত বছরের উল্লেখযোগ্য হারে হজের খরচ বেড়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে ছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০,২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে সীমিত পরিসরে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার। এসব হিসাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হলেও খরচের তারতম্য লক্ষ করা যায়। যেমন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা হাবের হিসাবে গত বছর হজের সর্বনিম্ন খরচ ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অথচ এবার সৌদি সরকার হজে আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। মোয়াল্লেমের খরচ কমিয়েছে। এ ছাড়া হজের সময় সৌদি সরকার নানা ধরনের সুবিধা বিনা মূল্যে প্রদান করে। মক্কা থেকে আরাফাহ, মিনা, মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য বিনা মূল্যে পরিবহনব্যবস্থা থাকে। সরকারের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি বিনা মূল্যে পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই উন্নতমানের বাসভাড়ার কথা বলে ১৯ হাজার আদায় অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক খরচ বলে মনে হয়েছে।
হজ প্যাকেজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, সরকারের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হজের মতো ধর্মপালনের রীতিকেও সরকার লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করছে। তা না হলে খরচ এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় খরচ বাড়তে পারে। এসব কারণে একলাফে হজের খরচ সাধারণের সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছে।
অবশ্য ব্যবসায়িক মুনাফার কথাটি সরকারের দায়িত্বশীলরা স্বীকার করবেন না। বরং করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের বাহানায় দাম যে আরও বাড়িয়ে ধরা হয়নি এই বলে কৃতিত্ব দেওয়ার চেষ্টা করবেন। হজে যে মানুষকে যেতে দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য বাহবা পেতে চাইবেন।
যেহেতু আমাদের দেশে কার্যত সর্বত্রই সীমাহীন লুটপাট চলছে, যে যেভাবে পারছে, লুটে নিচ্ছে; কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই; সেহেতু হজের এই অস্বভাবিবক খরচ বৃদ্ধির নেপথ্যে যে রাজনৈতিক শক্তির মদতপুষ্ট শ্রেণির অতিমুনাফালোভী গোষ্ঠীর হাত আছে, সে ধারণা করাই যায়। এ কারণেই সৌদি সরকার হজের বিভিন্ন খরচ হ্রাসের যে ঘোষণা দিয়েছে, তার প্রতিফলন হজ প্যাকেজে নেই। সৌদি সরকার ব্যয় হ্রাসের ঘোষণা না দিলে হয়তো এই বছর হজ প্যাকেজের মূল্য ১০ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকত।
নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য হজ পালন এখন স্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। এত টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে হজে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। অনেকেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে বা শেষ বয়সে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে হজে যান। স্বল্প আয়ের এসব মানুষ এখন যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করবেন হজ থেকে। যে কারণে অনেকেই ওমরাহ হজের দিকে আগ্রহী হচ্ছেন। সম্প্রতি ওমরাহ হজ পালন করেছেন—এমন লোকজন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার শ্রেণিগত পরিবর্তন হচ্ছে। আগে হজে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। আর উমরা ছিল উচ্চবিত্তের রীতি। এখন হজে উচ্চবিত্তরা বেশি যান। উমরায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ছে। কারণ, এত অর্থ ব্যয় করে সাধারণের পক্ষে হজে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক