স্তন ক্যানসার চিকিৎসা, যে মিথ ভাঙা এখন জরুরি

স্তন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত করা গেলে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এতে রোগীর জীবন রক্ষার পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক ব্যয়ও কম হয়।

অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ছয় লাখের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২০ সালে স্তন ক্যানসারে ২৩ লাখ নারী আক্রান্ত  হয়েছেন। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। এ দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যাচ্ছেন ৭ হাজারের অধিক নারী।

আশার কথা হলো, স্তন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত করা গেলে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এতে রোগীর জীবন রক্ষার পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক ব্যয়ও কম হয়। সাধারণত, ক্যানসার দেরিতে বা অ্যাডভান্স স্টেজে ধরা পড়লে চিকিৎসা যেমন জটিল ও কঠিন হয়, তেমনি ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে একজন ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় বছরে আনুমানিক ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা খরচ হয়।  ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপারেশন, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, চিকিৎসকের ফি, ক্লিনিক বা হাসপাতালের বেডভাড়া, বাড়ি থেকে রোগী ও রোগীর সঙ্গীর চিকিৎসাকেন্দ্রে আসা-যাওয়া, থাকা–খাওয়ার খরচ ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রথম দফার চিকিৎসা শেষ করার পর নিয়মিত ফলোআপ ও ওষুধের খরচ তো আছেই। বেশির ভাগ রোগীরই জীবনভর ওষুধ বা ওরাল কেমো নিতে হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল।

রোগীদের বড় অংশ আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চিকিৎসা নিতে পারেন না। জরিপ বলছে, হাসপাতালগুলোয় মাত্র ৪৫ হাজার ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। আর মোট রোগীর মাত্র ৫ শতাংশ দেশের বাইরে ক্যানসার চিকিৎসা নিতে যান। যাঁরা দেশের বাইর চিকিৎসা করাতে যান, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ।

একে তো দেশের সব মানুষের জটিল দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই, তারপর নারীদের ক্যানসার হলে অনেক পরিবারই হিসাব–নিকাশ করে ব্যয় করে। বাস্তবে নারীর চিকিৎসা পাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবারের আর্থিক সংগতির পাশাপাশি পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের ওপরও নির্ভর করে। তাই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও পুরুষদের সচেতন করা জরুরি। যে পরিবারে পুরুষেরা যত বেশি তৎপর–সচেতন, সে পরিবারে নারীর চিকিৎসা তত প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু করা যায়। নারী কেবল লজ্জায় নয়, বরং চিকিৎসা হবে কি না, সে বিষয়ে দ্বিধায় থাকেন বলে নিজেদের রোগবালাইয়ের কথা বলতে চান না।

চিকিৎসক, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক পেশেন্ট নেভিগেটর সিস্টেম প্রবর্তন করা যেতে পারে। স্বল্পকালীন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে আগ্রহী তরুণদের পেশেন্ট নেভিগেটর হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে তরুণদের বেকারত্ব কমবে। আবার রোগীরাও চিকিৎসা নিতে গিয়ে হায়রানির শিকার হবেন না। মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতালসহ নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় পেশেন্ট নেভিগেটর ব্যবস্থা সুফল বয়ে এনেছে। আমি নিজেও টাটা ক্যানসার হাসপাতালে পেশেন্ট নেভিগেটরদের কাছ থেকে বিনা মূল্যে সেবা নিয়েছি।

নারীরা স্তন ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হন বটে; তবে প্রতি হাজারে একজন পুরুষও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এমনকি পুরুষেরা স্তন ক্যানসার আক্রান্ত হলে নারীদের চেয়ে বেশি ‘লজ্জা’ পেয়ে থাকেন। সম্প্রতি এক পুরুষ বন্ধু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা ও করণীয় বিষয়ে পরামর্শের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বাভাবিকভাবেই কী ক্যানসার, তা জানতে চাইলে বললেন, ‘বুকে’। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। উনি খুব অস্বস্তি নিয়ে কথা বলছিলেন বলে আর বেশি কিছু জানতেও চাইনি। পরে অন্যজনের কাছে জানতে পারি, উনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। স্তন ক্যানসার নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর বিকল্প নেই।

আরেকটা অভিজ্ঞতা বলি। স্তন ক্যানসার সচেতনতা নিয়ে কাজ করেন—এমন একজন ক্যানসার সার্ভাইবার আমাকে জানিয়েছিলেন, উনি সমাজে তরুণীদের মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ‘ব্রেস্ট এনলার্জ’ করার জেল ও পিল ব্যবহারের প্রবণতা দেখেছেন। ব্যবহারকারীরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সেসব জেল বা পিল ব্যবহার ক্ষতিকর কি না? সমাজে নারীর সৌন্দর্যের ধারণা এত গভীরভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ক্ষতিকর পণ্যসামগ্রী বাজারে বিক্রি তো হচ্ছেই, আবার স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরও সার্জারি করবেন কিনা সেই দ্বিধায় থাকেন। স্তন ছাড়া অনেক নারী নিজেদের অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন। বিবাহিত নারীরা স্বামীর অনুমোদন ছাড়া সচরাচর ব্রেস্ট সার্জারি করেন না। এর কারণ, তাঁরা দাম্পত্য সম্পর্ক নড়বড়ে বা ছেদের ভয় পান। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় ভয়টা অমূলক নয়। তবে ভরসার কথা হচ্ছে, ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর পাশে থাকা পুরুষ সঙ্গী ও পরিবারের সংখ্যা এখন অনেক বেশি।

এসব কারণে নারীর প্রতি ও নারীর সৌন্দর্য–সম্পর্কিত বিদ্যমান ধারণা পাল্টানো বা মিথ ভাঙার জন্য মিডিয়া ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জরুরি। জরুরি শৈশব থেকেই নারী-পুরুষের শরীর ও প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া। ‘স্তন নারীর একটি স্বাভাবিক অঙ্গ’—এ ধারণা যত দিন পর্যন্ত না প্রতিষ্ঠা করা যাবে, তত দিন পর্যন্ত স্তন ক্যানসার নিয়ে লজ্জা বা ট্যাবু দূর করা সহজ হবে না।

আবার স্বাস্থ্য নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হলেও চিকিৎসার ব্যয় যেহেতু নিজেদেরই মেটাতে হয়, তাই প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ সুস্থতার প্রতি নজর দিয়ে যতটুকু সম্ভব সুস্থ থাকার জন্য সচেষ্ট হওয়ার বিকল্প নেই। স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে নারীদের সেলফ এক্সামিন বা নিজ স্তন নিজে পরীক্ষা করার বিষয়টি সঠিকভাবে জানা ও চর্চা করা প্রয়োজন। স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে এই সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নারীর বৃহৎ অংশও কিন্তু এখনো নিয়মিতভাবে নিজ স্তন পরীক্ষা করে না।

এ ছাড়া, গ্রামীণ বা প্রান্তিক নারীদের কাছে সেলফ এক্সামিনের বার্তাটি এখনো ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়া যায়নি। তাঁদের স্তন পরীক্ষার পদ্ধতিটি হাতেকলমে শেখানো প্রয়োজন। গ্রামীণ নারীদের শেখানোর কাজটি খুব সহজেই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির (যেমন ভিডব্লিউবি, মা ও শিশু সহায়তা, বিধবা ভাতা) মাধ্যমে হতে পারে। সেসব কর্মসূচির উপকারভোগী নারীদের প্রশিক্ষণ বা ভাতা গ্রহণের সময় স্থানীয় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সেলফ এক্সামিনের পদ্ধতি শেখাতে পারেন। এ ছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় কলেজপড়ুয়া নারী শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের মাধ্যমে সেলফ এক্সামিনের বিষয়টি স্থানীয় নারীদের শেখানো যেতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা গ্রামের প্রতিটি ঘরে যান। তাঁদের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ির নারীদের সেলফ এক্সামিন শেখানো ও তদারকি সম্ভব। সে জন্য প্রয়োজন আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।  

স্তন ক্যানসারসহ ক্যানসার চিকিৎসায় রাষ্ট্রকে বিশেষ স্বাস্থ্যবিমা ঘোষণা করা প্রয়োজন। ২০৩০ সালের মধ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। ‘নো ওয়ান লেফট বিহাইন্ড’ বাস্তবায়ন করতে হলে ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ স্লোগানের আলোকে কার্যকর নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন চিকিৎসা খাতে গবেষণা বাড়াতে হবে। অবকাঠামো, যন্ত্রাদির পাশাপাশি চিকিৎসকদের উন্নততর প্রশিক্ষণ ও সুযোগ বাড়াতে হবে। সুলভে সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসক, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক পেশেন্ট নেভিগেটর সিস্টেম প্রবর্তন করা যেতে পারে। স্বল্পকালীন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে আগ্রহী তরুণদের পেশেন্ট নেভিগেটর হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে তরুণদের বেকারত্ব কমবে। আবার রোগীরাও চিকিৎসা নিতে গিয়ে হায়রানির শিকার হবেন না। মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতালসহ নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় পেশেন্ট নেভিগেটর ব্যবস্থা সুফল বয়ে এনেছে। আমি নিজেও টাটা ক্যানসার হাসপাতালে পেশেন্ট নেভিগেটরদের কাছ থেকে বিনা মূল্যে সেবা নিয়েছি।

ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা কেবল নারীদের নয়, পুরো সমাজকেই হতে হবে। আর ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেবল সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে সমাজের অন্য প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। রণদা প্রসাদ ক্যানসার চিকিৎসায় ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতালে দেশের প্রথম রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন করেছিলেন।  
জাহান-ই-গুলশান : ক্যানসারজয়ী ও সহকারী পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
[email protected]