বরং সারা দেশেই কথিত ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয় কেন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের মতো দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আগ্রহী নয়।ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী দেশের তরুণদের প্রায় ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ পড়ালেখা বা কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। সংখ্যাটা প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ।

তরুণদের বড় অংশই অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না। অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে জনসংখ্যায় তরুণদের আধিক্য থেকে, অর্থাৎ ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুফল কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। বহু কারণের মধ্যে দুটি কারণ হচ্ছে আমাদের ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’ ও ‘দক্ষতাহীন শিক্ষা’।

সরকারি হিসাবে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ হলেও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা এর বহুগুণ। প্রায়ই একটি মানসম্পন্ন চাকরির বিজ্ঞাপনের বিপরীতে হাজার হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ার নজির সামনে আসছে। করোনার পর বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী কমে গেছে, বাল্যবিবাহ ব্যাপক বেড়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্ররাজনীতি সচল থাকলেও বেকারত্ব নিয়ে, শিক্ষা দক্ষতায় বিনিয়োগ নিয়ে, মাদ্রাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কর্মমুখী দক্ষতাভিত্তিক সংস্কার নিয়ে তারা কথা বলে না কেন? বর্ধিত শিক্ষা বরাদ্দ ও কর্মবান্ধব সরকারি অর্থনৈতিক নীতি তৈরিতে তারা সরকারকে চাপ দেয় না, আন্দোলন করে না কেন?

আরও পড়ুন

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ দাবিটিকে জাতীয় পরিসরে এনে আরও বিস্তৃতভাবে দেখার সময় হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সরকারদলীয় ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মানুষ হত্যার চর্চা ছাড়া ভালো কোনো কাজ সাম্প্রতিক কোনো মেমোরিতে দেখা যায় না। সার্বিকভাবে ১৯৯০ সালের পর আমাদের ‘কালেকটিভ মেমোরিতে’ ছাত্ররাজনীতি বলতে ভয় ও আতঙ্ক, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কোনো কিছু নেই।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় অতীত আছে সত্য। কিন্তু সেগুলো সুদূর অতীত, সেগুলোর বরাত দিয়ে বর্তমানের সন্ত্রাসকে যৌক্তিকতা দেওয়া যাবে না।

এক.

রড, হাতুড়ি, হেলমেট, হকিস্টিক ইত্যাদি ব্যবহার করে ‘মানুষ’ পেটানো ছাত্রলীগকে বুয়েট ক্যাম্পাসে চান ১ হাজার ২১৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১ জন। অন্য ১ হাজার ২১৪ শিক্ষার্থী ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করেছেন। (দেশের আদালতের আদেশেও এই ‘ডেমোক্রেটিক চয়েসের’ প্রতিফলন আমরা দেখি না)

এভাবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম ও পেটানোর সংস্কৃতি উঠিয়ে দিতে পারলে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের প্রতি সমর্থনের মাত্রার কোনো কোনো হেরফের হবে বলে মনে হয় না। (বুয়েটে রাজনীতি ফেরাতে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে সর্বোচ্চ উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচজন!)

বিরাজনৈতিকীকরণ থামাতে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির দরকার আছে, যেখানে গণরুম ও পেটানোর সংস্কৃতি থাকবে না, কেউ মিছিলে যেতে বাধ্য হবেন না। দলীয় ব্যক্তিরা সরকারি নিয়োগে প্রাধান্য পাবে না। কিন্তু এ ধরনের ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ বর্তমানে অসম্ভব। তাই সার্বিকভাবে সারা দেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকাই মঙ্গল। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

দুই.

পথভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতিকে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে পেতে চায় না। এটা ন্যায্য দাবি। ‘শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, বর্তমান সরকারদলীয় সংগঠন মানেই একধরনের আতঙ্ক। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ থাকলে আবার আবরারের মতো তাঁদের কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা হবে।’ (ডেইলি স্টার, ১ এপ্রিল ২০২৪) আবরার ফাহাদ হত্যা-পরবর্তীকালে ছাত্রলীগকে প্রতিহত করা এবং সার্বিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ঐক্য অভূতপূর্ব।

পাশাপাশি দেশের সেরা শিক্ষার্থীদের দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে আমাদের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের উচিত হবে শিক্ষার পরিবেশের ক্ষেত্রে সেটিকে আরও বিস্তৃতভাবে দেখা, অর্থাৎ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্ররাজনীতির মতো জঞ্জাল থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানানো উচিত। এখানে শিক্ষকদের নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি ও অপরাজনীতি বহাল রেখে শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাস বন্ধে সফল হবে না।

বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস, গণরুম, চাঁদাবাজি ও পেটানোর সংস্কৃতির সমার্থক। ছাত্রলীগ ছাড়া সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য কোনো বাম-মধ্য-ডান সংগঠনের সেই অর্থে শক্ত অবস্থান বা তৎপরতা নেই, শুধু নামকাওয়াস্তে কমিটি আছে। বিরোধীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে গেলেই বেদম মার দেওয়ার সংবাদ মাঝেমধ্যেই খবরে আসে।

শুধু বুয়েট নয়, বরং দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন পাওয়ার অধিকার আছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতি শুধু বুয়েটে নয়, বরং সারা দেশেই সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হবে। দাবিটি এখনো তোলা হয়নি।

আরও পড়ুন

তিন.

সার্বিকভাবে ছাত্ররাজনীতির পথ হারিয়েছে বলে বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়াই উত্তম। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ইশা ছাত্র আন্দোলন—কেউই কি আজ ছাত্রসমাজের কল্যাণে ছাত্ররাজনীতি করছে বা করতে পারছে?

শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হতে হয় ছাত্রলীগের দখল ও সন্ত্রাসের কারণে কিংবা সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মাতৃসংগঠনের রাজনৈতিক যুক্ততার কারণে। এ ধরনের পরাধীন ছাত্ররাজনীতির দরকার নেই।

শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নীতি ও রাজনীতি নিয়ে ডিবেটিং ক্লাবে বিতর্ক করবেন, বিভিন্ন ক্লাব করবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রিকায় লিখবেন, ব্লগ করবেন, জাতীয় ইস্যুতে সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবাদ করবেন। দলীয় রাজনীতি করতে চাইলে দলের অফিসে গিয়ে পলিসি স্টাডি করবেন। ক্যাম্পাসে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, ছাত্রীদের হেনস্থা করা, চাঁদাবাজি, ফাউ খাওয়া এবং আবরারের মতো অন্যদের পিটিয়ে মারার সুযোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই।

চার.

তবে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরাজনৈতিকীকরণ প্রকল্পে বাধা দিতে ভবিষ্যতে নতুন পরিবেশে ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাসহীন নতুন মডেলের সূচনা করতে হবে।

মেধাবীরা যদি দেশের পলিসি ও সুশাসন নিয়ে কাজ না করে, শুধু করপোরেট ও বিদেশি কোম্পানির দক্ষ চাকুরে হতে থাকেন, তাহলে দেশটা সেই স্বল্প শিক্ষিত, অযোগ্য, সন্ত্রাসীরাই শাসন করবে। রাজনীতিতে মেধা-ভিত্তিক জনবল যুক্ত করার একটা স্থায়ী পথ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

অর্থাৎ বিরাজনৈতিকীকরণ থামাতে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির দরকার আছে, যেখানে গণরুম ও পেটানোর সংস্কৃতি থাকবে না, কেউ মিছিলে যেতে বাধ্য হবেন না। দলীয় ব্যক্তিরা সরকারি নিয়োগে প্রাধান্য পাবে না। কিন্তু এ ধরনের ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ বর্তমানে অসম্ভব। তাই সার্বিকভাবে সারা দেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকাই মঙ্গল। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

তত দিন আগ্রহী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে এসে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে, দলীয় পলিসি ফোরামে, সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হয়ে ছাত্ররাজনীতি করবেন।

ছাত্ররাজনীতিতে তাঁরা যদি পলিসি স্টাডি না করেন, দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক না করেন, সমাজ দর্শন, বৈশ্বিক জ্ঞান, বিশ্বব্যবস্থার ওপর চর্চা না করেন, তাহলে বর্তমান মডেলের লাঠিয়াল ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই।

বর্তমান যুগে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ক্যাম্পাস-সংশ্লিষ্টতার একমুখী কোনো সম্পর্ক নেই। ক্যাম্পাসের দাবিদাওয়া-ভিত্তিক আন্দোলন করতে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক সংশ্লিষ্টতার দরকার পড়ে না।

পাঁচ.

বলা হয় বুয়েট আলাদা। এটা একদিকে সত্য, প্রাতিষ্ঠানিক গৌরব ও ঐতিহ্যকে প্রোটেকশন দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে একই গৌরব কেন অন্যদের নেই, সেই প্রশ্নও কিন্তু ওঠাতে হবে। তাই দাবিটি অন্যদিকে বৈষম্যপূর্ণও।

স্বাধীনতার ৫৩ তম বছরে এসেও আমরা কি ‘উন্নত শিক্ষা ও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার’ মতো বিষয়টি শুধু একটি বা দুটি এলিট প্রতিষ্ঠানের জন্যই সীমাবদ্ধ রাখব? বাকিরা কবে মানে ও জাতে উঠবে? দেশের অন্য সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা হয় না, কেন সেখানকার পরীক্ষাপদ্ধতি মানহীন, শ্রেণিশিক্ষা মানহীন এবং পঠিত কোর্সগুলো চাকরির বাজারে আবেদনহীন ও চাহিদাহীন—সেসব আলাপ উঠুক জোরালোভাবে।

বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও খ্যাতিমান শিক্ষকেরা বলছেন, সরকারি সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।

এসব নিয়ে কথা না বললে চিন্তা ও বুদ্ধিজীবিতা নিজেই ভঙ্গুর থেকে যাবে, জাতীয় স্তরে জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হবে। আমরা কি আদালত কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোথাও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠান গড়তে পারছি? স্বাধীনতার ৫৩ তম বছরে একটি ভালো প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আয়োজন কেন? সময়ের প্রয়োজনে প্রশ্নগুলো আলোচনার টেবিলে উঠুক।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। গ্রন্থকার: ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’; ‘বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর’; ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা’; ‘বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য’; ‘উন্নয়নের নীতি ও দর্শন’; ‘ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, বেকারত্ব ও বিসিএস’। ই-মেইল: faiz. taiyeb@gmail. com