ভারতে সরকার বলছে, দারিদ্র্য কমছে, আসলে কি তা–ই

শতকোটিপতি মুকেশ আম্বানির ছেলের প্রাক বিবাহে ১২ কোটি ডলার খরচ করার কথাই বিবেচনা করুন। ছেলেটি ১০ লাখ ডলারের ঘড়ি পরেছিল।ছবি : রয়টার্স

প্রয়াত ঝানু অর্থনীতিবিদ মাইকেল মুসা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আমার প্রথম বস একবার আমাকে বলেছিলেন, প্রতিটি যথার্থ পরিসংখ্যানকে অবশ্যই ‘গন্ধ পরীক্ষায়’ (স্মেল টেস্ট) পাস করে আসতে হবে। সম্প্রতি ভারত সরকার গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভোগ বা নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করার পর তাঁর সেই মহান বাণীটি আমার মনে পড়ল। তিনি ‘গন্ধ পরীক্ষা’র কথা বলেছিলেন। আর ভারতের এই সরকারি পরিসংখ্যান থেকে আমি স্রেফ দুর্গন্ধ পাচ্ছি।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ভারতের সরকারি জিডিপি সংক্রান্ত উপাত্ত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস যে পরিসংখ্যান দাখিল করেছে, তাকে একটি নির্লজ্জ অতিমূল্যায়িত পরিসংখ্যান বলা যেতে পারে।

ভারতে সর্বশেষ দশকের আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। ওই সময়ে জরিপে জনগণের মধ্যে উচ্চমাত্রার অপুষ্টি এবং রক্তস্বল্পতাকে হাইলাইট করার খেসারত হিসেবে জরিপ প্রকল্পের পরিচালককে চাকরি খোয়াতে হয়েছিল। ২০১২ সালের সর্বশেষ বিশদ ভোগ-ব্যয় জরিপ থেকে দেখা যায়, ভারতের ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের হার আরও বাড়তে পারে—এইরকম ইঙ্গিতসূচক তথ্য ফাঁস হওয়ার পর সরকার ২০১৮ সালে একটি সমীক্ষা বা জরিপ বাতিল করে।

এতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, নতুন একটি অসমাপ্ত ভোগ-পরিসংখ্যান সরকারি শিবিরের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছে। আইএমএফ-এ ভারতের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সুরজিত ভল্লা ও অর্থনীতিবিদ করণ ভাসিন বুকিংস ইনস্টিটিউশন-এর অর্ধ সমাপ্ত জরিপের আলোকে বেশ তাড়াহুড়া করে ঘোষণা করেছেন, ভারত থেকে চরম দারিদ্র্য ‘দূরীভূত হয়েছে’। পরিসংখ্যানের এই ধরনের অপব্যবহার অভিজাত মহলে ভারতের ‘হাইপ’কে জোরাল করলেও আদতে দেশটিতে দারিদ্র্য গভীরভাবে রয়েই গেছে। দরিদ্র মানুষের আয় লক্ষণীয়ভাবে কমে যাওয়ার কারণে যে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যাপক জনবঞ্চনাকেই সামনে নিয়ে আসছে।

আদতে দারিদ্র্য পরিমাপ করা একটি জটিল কাজ। দারিদ্র্যের সীমা নির্ধারণ করাই এই কাজের মূল লক্ষ্য। বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা হিসেবে দৈনিক আয় এক ডলার নির্ধারণ করেছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে ২০১১ সালে তা ১.৯০ ডলারের উন্নীত করা হয়। অর্থাৎ যারা দৈনিক ১.৯০ ডলার খরচ করার সামর্থ্য রাখেন না, তাঁদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা লোক হিসেবে গণ্য করা হয়।

আরও পড়ুন

ভারতে দৈনিক ১.৯০ ডলার খরচ করতে পারেন না, এমন লোকের সংখ্যা সরকারের দাবিকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। অর্থনীতিবিদ সাহুয়া চেন ও মার্টিন রেভালিওন মনে করেন এই অর্থ দিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার মতো খাবার জোগাড় করা ও অন্য সামান্য কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করা সম্ভব।

দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ এস. সুব্রামানিয়ানের মতে, ২০১২ সালে যখন দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণে দৈনিক সর্বনিম্ন আয় ১.৯০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন ভারত ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে সক্ষম হিসেবে যাঁদের দেখিয়েছিল, তাঁরা আদতে তখন দিনে সর্বোচ্চ ৩০ রুপি খরচ করতে পারছিল। এই সামান্য অর্থ দিয়ে তাঁরা কোনো মতে দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারছিল।

সম্প্রতি ভল্লা ও ভাসিন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর নির্ধারিত ১.৯০ ডলার খরচ করার সক্ষমতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, তাতে দাবি করা হয়েছে, ভারতের বেশির ভাগ মানুষই দৈনিক ১.৯০ ডলারের চেয়ে বেশি খরচ করে। তাঁদের হিসাব দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২২.৯ রুপি দেখিয়েছেন। তাঁদের বিশ্লেষণে তাঁরা দৈনিক ৪৫ রুপির কম খরচ করা লোকজনকে দরিদ্র শ্রেণিতে রেখেছেন।

এটি দারিদ্র্য দূরীকরণের আসল চিত্র প্রকাশ করে না। সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তি মেনে নিয়ে গড় বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ শতাংশ ধরে নিলে দেখা যাবে ২০১২ যে জিনিসের দাম ৩০ রুপি ছিল এখন তার দাম কমপক্ষে ৫৮ রুপি হবে। অধিকন্তু, নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলো মুদ্রাস্ফীতি বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। কারণ এক সঙ্গে তাঁদের প্রচুর পরিমাণে পণ্য কেনার ক্ষমতা থাকে না। ফলে তাঁদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে।

দুঃখের বিষয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরিবারভিত্তিক আয়ের বিপরীতে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে না। ভারতে অর্থনৈতিকভাবে নিচের দিকে থাকা অর্ধেক পরিবারের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি যদি ৮.৫ শতাংশ হয় তাহলে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে তাদের প্রতিদিন প্রায় ৮০ রুপি লাগবে। সে ক্ষেত্রে, ভারতের দারিদ্র্যের হার হবে প্রায় ২২ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১২ সালের মতোই।

কোভিড-১৯ মহামারি ভারতকে কঠিন ধাক্কা দিয়েছে। এর ফলে লাখ লাখ ভারতীয় শ্রমিক নিম্ন-উৎপাদনশীল কৃষিভিত্তিক কাজে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় আজ ৭ কোটি বেশি ভারতীয় নাগরিক কৃষিতে কাজ করছেন। এই কাজ তাঁরা করছেন অ-কৃষি কাজের সুযোগের অভাবের কারণে।

লাখ লাখ ভারতীয়দের দুঃসহ জীবনের মুখে পড়লেও জাতীয় নির্বাচনের আগে আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে ভল্লা ও ভাসিনের দারিদ্র্যের অবসানের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা দরিদ্র মানুষের সঙ্গে তামাশা করা ছাড়া আর কিছু নয়। ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যের বিষয়টিকেও তাঁরা চেপে গেছেন।

আরও পড়ুন

সবাই দেখছে, ভারতের ধনী-গরিবের ব্যবধান অবাক করার মতো। শতকোটিপতি মুকেশ আম্বানির ছেলের প্রাক বিবাহে ১২ কোটি ডলার খরচ করার কথাই বিবেচনা করুন। ছেলেটি ১০ লাখ ডলারের ঘড়ি পরেছিল। সেখানে পারফর্ম করার জন্য একজন সুপারস্টার ৬০ লাখ ডলার পেয়েছিলেন।

অন্যদিকে, দরিদ্র লোকেরা ঠিকমতো খেতেও পাচ্ছে না। আর সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য কমছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
অশোকা মোদি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর। এর আগে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে কাজ করেছেন।