এক মালিকের কোমরে দড়ি, আরেক মালিককে কেন ছাড়?

গত বছর সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর এ বছর বছর সীতাকুণ্ডে সীমা গ্রুপের একটি অক্সিজেন কারখানায় ঘটে বিস্ফোরণ।

করোনাকালে অক্সিজেনের হাহাকারের সময় সীমা গ্রুপ হাজার হাজার সিলিন্ডার অক্সিজেন বিনা মূল্যে দিয়েছে, এমন একটা কথা আমরা শুনতে পেলাম জাহাজভাঙা শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সভাপতি আবু তাহের এর মুখে। তাঁর এই বক্তব্য এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একটি ঘটনার প্রসঙ্গক্রমে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের পর একটি মামলায় কারখানাটির তিন মালিককে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অন্যতম মালিক পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে। তাঁকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় কোমরে দড়ি বাঁধা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছে বিএসবিআরএ। মানববন্ধনের মতো কর্মসূচির পাশাপাশি সীতাকুণ্ডের সব অক্সিজেন কারখানা শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁরা, যা পরে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রত্যাহার করা হয়।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো ১৭ মার্চ, ২০২৩-এর প্রতিবেদনে আবু তাহের অভিযুক্ত পারভেজ উদ্দিনকে নিয়ে আরও কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর হতাহতদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ ২ লাখ টাকা থাকলেও সীমা গ্রুপ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে ১০ লাখ টাকা। আহত শ্রমিকদের ২ লাখ টাকা, যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এটি অবশ্যই বড় নজির। তবে প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখি, জেলা প্রশাসনের ‘চাপে’ এই ক্ষতিপূরণ বাড়িয়েছে সীমা অক্সিজেন কারখানা। যা হোক, বাড়তি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরও তাঁকে গ্রেপ্তার করে কোমরে দড়ি বাঁধা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করার কথা কী? অভিযুক্তকে কোমরে দড়ি বাঁধার এই দেশে কোনো একজন মানুষকে সেটা করা হবে না কেন, আসতেই পারে সে প্রশ্ন।

একজন শিল্পপতির কোমরে দড়ি বাঁধা না গেলে অন্য মানুষের কোমরে দড়ি বাঁধা হলে সেটা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ (সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী)-এর ব্যত্যয় ঘটায় কি না, সেই আলোচনাও জরুরি। আসা উচিত এই প্রশ্নও, দেশের যেকোনো একজন নাগরিকের কোমরে অবমাননাকরভাবে দড়ি কেন বাঁধা হবে? অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে শোরগোলের প্রেক্ষাপটে পুলিশ সংশ্লিষ্ট এসআইকে ক্লোজ করেছে।

সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানার তিন মালিকের মধ্যে একজন পারভেজ উদ্দিন ওরফে সান্টু
ছবি: সংগৃহীত

এই আলাপগুলোর গভীরে করছি না আর, আমি বরং আলোকপাত করতে চাই ভিন্ন একটা দিকে। কল্পনা করা যাক জনাব পারভেজ উদ্দিনের মনস্তত্ত্ব। ধরে নেওয়া যাক, তাঁকে অবমাননাকরভাবে কোমরে দড়ি বাঁধা হয়নি, শুধু গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবুও কি তিনি নিজেকে ভীষণ দুর্ভাগা ভাবতেন না? কিংবা কেউ বলতেই পারেন তিনি ভীষণ ‘বোকা’। কেন তিনি নিজেকে দুর্ভাগা ভাববেন কিংবা কেনই-বা তাঁকে বোকা মনে করা হবে, সেটার ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য নানা ডামাডোলে আমাদের মনোযোগ থেকে সরে যাওয়া সীতাকুণ্ডেই ঘটা আরেকটি ভয়ংকর ঘটনা একটু স্মরণ করা জরুরি।

গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন ৫১ জন মানুষ। এতে জীবন দিয়েছিলেন ১৩ জন অগ্নিনির্বাপণ কর্মী। কেন সেটা ঘটেছিল শোনা যাক, বাংলাদেশের দমকল বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিমের মুখে। ঘটনার পরদিন তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, আগুন লাগার পর তাঁরা কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাননি। সেটা পেলে এত বেশি হতাহত হতো না।

তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের বাহিনীর প্রথম যে সদস্যরা গিয়েছিলেন, সেখানে যে কেমিক্যাল ছিল, এই আইডিয়া তাঁরা পাননি। তাই শুরুতেই তাঁরা যখন অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়েছিলেন, তখন ওই বিস্ফোরণ হওয়ার কারণে তাঁদের বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হন।’ (বিবিসি বাংলা ৫ জুন ২০২২)

আরও পড়ুন

আমরা পরে জানতে পারি ওই গুদামে আসলে অনেকগুলো কনটেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল। এই অতিমাত্রায় দাহ্য কেমিক্যালটি তৈরি হতো কনটেইনার টার্মিনালের মালিক স্মার্ট গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের ডিপোতে। দুর্ঘটনার পরই বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলেছিল, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো অধিক দাহ্য কেমিক্যাল মজুত করার অনুমতি নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তালিকায় ওই প্রতিষ্ঠানের নামও নেই।

এটা তখনই স্পষ্ট হয়েছিল অনুমতি ছাড়া টার্মিনালে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাখা এবং অগ্নিকাণ্ড শুরুর পর সেই তথ্য না দেওয়ার কারণেই অগ্নিনির্বাপণ কর্মীসহ অনেক বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। প্রাথমিক বিবেচনায় এতে মালিকপক্ষের সরাসরি দায় বোঝা যায় সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই। কিন্তু তখন মালিকপক্ষকে গ্রেপ্তার করা দূরেই থাকুক, মামলার আসামিও করা হয়নি।

আরও পড়ুন

মামলা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম জানান, সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী মঙ্গলাবার রাতে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় এ মামলা করেন যেখানে ডিপোতে অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একটি দৈনিককে বলেন, আসামির তালিকায় ডিপোর কর্মকর্তারা থাকলেও প্রাথমিকভাবে মালিকপক্ষের কাউকে রাখা হয়নি। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে, তদন্তে যদি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, মালিকদেরও আসামি করা হবে।

আগেই বলেছি ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকা আর সেই তথ্য না দেওয়া নিয়ে খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে মালিকপক্ষের ‘অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতি’ স্পষ্ট প্রমাণ ছিল। কিন্তু তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তদন্ত সাপেক্ষে যদি তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে...।’

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকলে ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় অতি সহজে আর ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া যায় শত শত এমনকি হাজার হাজার কোটি টাকা। আর বীভৎস দুর্ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট দায় দেখা গেলেও আইন তার তথাকথিত নিজস্ব গতিতে চলবে, সেই ব্যক্তিকে বাইপাস করে।

এটুকু জানার পর একজন সচেতন পাঠকের মনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন আসবে তাহলে সীমা অক্সিজেনের মালিকদের একজনকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কেন তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার অপেক্ষা করা হয়নি? গ্রেপ্তার তো করা হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে, সঙ্গে রীতিমতো কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নেওয়া হয়েছে।

কোনো শিল্প দুর্ঘটনার জন্য শিল্প মালিককে গ্রেপ্তার তাৎক্ষণিকভাবে হওয়া উচিত, নাকি সেটা তদন্তের পর হওয়া উচিত, সেই বিতর্ক উপস্থাপন করা এবং সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া এই কলামের উদ্দেশ্য নয়। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন একই রকম দুটো ঘটনায় যেটিতে বরং মালিকপক্ষের খুব সরাসরি গুরুতর দায় আছে বলে প্রাথমিকভাবেই মনে হয়, সেই ক্ষেত্রে (বিএম কনটেইনার টার্মিনাল) মালিকপক্ষের কাউকে গ্রেপ্তার করার জন্য তদন্তে দায়ী থাকার প্রমাণ পাওয়ার অপেক্ষার কথা বলা হয়। কিন্তু আরেক ক্ষেত্রে (সীমা অক্সিজেন) যেখানে প্রাথমিকভাবে অন্তত মালিকপক্ষের বড় কোনো সরাসরি দায়ের প্রাথমিক প্রমাণ নেই, সে ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন ৫১ জন মানুষ। এতে জীবন দিয়েছিলেন ১৩ জন অগ্নিনির্বাপণ কর্মী।
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্নটা এই বৈপরীত্য নিয়ে। প্রশ্নটা আইনের এই ভিন্ন প্রয়োগ নিয়ে। বিএম কনটেইনার টার্মিনালের দুর্ঘটনার পর সরকারি প্রতিক্রিয়া দেখলে সীমা অক্সিজেনের মালিকের শুধু গ্রেপ্তার হওয়ার কারণেই নিজকে দুর্ভাগা মনে হওয়ার কথা (এমনকি কোমরে দড়ি না বাঁধা হলেও)।

কেন আইনের এমন ভিন্ন প্রয়োগ ঘটল এই দুই ক্ষেত্রে, এই দেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখা মানুষ এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে দিতে পারবে নিশ্চয়ই। আমরাও একটু দেখে নিই।

বিএম কনটেইনার ডিপোর মূল কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বিএম কনটেইনার ডিপোর চেয়ারম্যান বার্ট প্রঙ্ক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক হলেন স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। মুজিবুর সম্পর্কে মোস্তাফিজুরের ভাই। মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে আছেন। বিগত সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তবে তাতে সাড়া দেয়নি দল।

সংসদ সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন না পেতে পারেন সে যাত্রা, কিন্তু দেশের ক্ষমতাসীন দলের একটি সাংগঠনিক জেলার কোষাধ্যক্ষ বেশ বড় পদ তো বটেই। মামলার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের নাম না থাকার জন্য এই পদ যথেষ্টর বেশি, এটুকু নিশ্চয়ই বুঝি আমরা। ওদিকে সীমা অক্সিজেনের মালিকপক্ষের কারও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পদে থাকা, এমনকি দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার তথ্য আমি অন্তত মিডিয়ায় দেখিনি।

এ দেশে যখনই কোনো অপরাধ ঘটে, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে আপ্তবাক্যের মতো বলা হয় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সত্যি বলতে, এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো দিনও আইনের ‘নিজস্ব গতি’ ছিল না। আইনের গতি মানেই হচ্ছে সরকার যে গতি ঠিক করে দেয়, সেটাই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের গতি কতটুকু ঠিক করে দেবে আর কতটুকু আইন নিজেই নিজের ঠিক করতে পারবে, সেটার মাত্রাগত হেরফের হয়েছে বিভিন্ন শাসনামলে। বলা বাহুল্য, বর্তমান সরকারের সময়ের মতো আইনের এমন সর্বগ্রাসী ‘সরকারি গতি’ ছিল না।

আরও পড়ুন

কলামের শুরুর দিকে বলছিলাম সীমা অক্সিজেনের গ্রেপ্তার হওয়া মালিককে নিশ্চয়ই অনেকেই বোকা মনে করবেন। মোটামুটি বড় একটা ব্যবসা করবেন, কিন্তু সরকারি দল করবেন না, এটা তো আসলে ‘বোকামিই’। সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা মুক্ত থাকতে পারেন ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের চাঁদাবাজি এবং ঘুষসহ নানা হয়রানি থেকে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকলে ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় অতি সহজে আর ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া যায় শত শত এমনকি হাজার হাজার কোটি টাকা। আর বীভৎস দুর্ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট দায় দেখা গেলেও আইন তার তথাকথিত নিজস্ব গতিতে চলবে, সেই ব্যক্তিকে বাইপাস করে।

বর্তমান বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে (সরকারি চাকরি কিংবা সরকারি দলের সূত্রে) সরকারের সঙ্গে যুক্ত না থাকা গেলে যেকোনো সাধারণ নাগরিকের জন্য কোনো সহজ জীবন তো নেইই, তাঁর জীবন নানাভাবে হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ। সীমা অক্সিজেনের মালিকপক্ষের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই ঘটনার পর কি তাঁদের পরামর্শ দেবেন সক্রিয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করার? কিংবা মালিকপক্ষ নিজেই কি ভাববে না সেটা? দেশের আর সব নাগরিকের কাছেও কি যাচ্ছে না একই বার্তা?

  • জাহেদ উর রহমান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক