আমরা এখন বসবাস করছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে, যেখানে প্রযুক্তি অভাবনীয় গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রসারিত ডেটা সংরক্ষণ, বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং বজ্রগতির প্রক্রিয়াকরণ ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে উদ্ভাবন আমাদের কত দূর নিয়ে গেছে। তবে প্রকৃত পরিবর্তন আসে যখন ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একত্রিত হয়। এ সংমিশ্রণকে বলা হয় এআইওটি (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অব থিংস)—যা ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের ধরনকে আমূল পাল্টে দিচ্ছে। এখন আর মেশিন শুধু নির্দেশ মেনে চলে না; তারা মানুষের মতো চিন্তাভাবনার কাছাকাছি গিয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারে।
আইওটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়—এটি ভবিষ্যতের জানালা। দেশগুলোর জন্য আসল চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ হলো কতটা কার্যকরভাবে তারা এই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে আইওটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে, শিল্প খাতকে রূপান্তরিত করবে এবং দৈনন্দিন জীবনকে আরও স্মার্ট, নিরাপদ ও দক্ষ করে তুলবে। এখন প্রশ্ন আর এই নয় যে এই রূপান্তর ঘটবে কি না; বরং প্রশ্ন হলো—সমাজগুলো কত দ্রুত এটিকে গ্রহণ করতে পারবে এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।
ইন্টারনেট অব থিংস ইতিমধ্যেই আধুনিক প্রযুক্তিকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে। এটি স্মার্ট ডিভাইস ও নেটওয়ার্কের একটি আন্তসংযুক্ত ইকোসিস্টেম তৈরি করে, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ, স্বয়ংক্রিয়তা এবং ডেটা বিনিময় সম্ভব হয়। আইওটি সিস্টেম সাধারণত লো-পাওয়ার ইলেকট্রনিকস এবং ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে, যা দক্ষ, সম্প্রসারণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংযোগ নিশ্চিত করে। বাস্তবে আইওটি ব্যবহৃত হয় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বিদ্যুৎ খরচ, গাড়ির অবস্থান বা স্বাস্থ্যগত সূচক পর্যবেক্ষণে।
এখন বাড়ির বাসিন্দারা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে দূর থেকেই বাতি বা এসি চালু-বন্ধ করতে পারেন। কৃষকেরা স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার ব্যবহার করেন, যা মাটির আর্দ্রতা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নামলেই চালু হয়ে যায়। মেশিনগুলো তাদের কম্পনের ডেটা সংরক্ষণ করে, যাতে টেকনিশিয়ান পরে পরীক্ষা করতে পারেন। তবে আইওটি-এর একটি সীমাবদ্ধতা আছে—এটি বিপুল পরিমাণ ডেটা তৈরি করে, কিন্তু সেগুলোর গভীর বিশ্লেষণ করতে পারে না। সেখানে এখনো মানুষের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
বিশ্ব যখন স্মার্ট স্বয়ংক্রিয়তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে পিছিয়ে থাকতে পারে না। আইওটি ও এআইয়ের সমন্বয় আর বিলাসিতা নয়—এটি ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম শর্ত। নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে; শিল্প খাতকে স্বল্পমেয়াদি লাভের বাইরে গিয়ে উদ্ভাবন গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে; আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরবর্তী প্রজন্মকে অভিযোজনযোগ্য দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে হবে।
সেখানেই আসে এআই, আইওটির সেন্সিং ও সংযোগের ওপর ‘চিন্তা ও শেখার’ স্তর যোগ করে এআই এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করে, যা শুধু ডেটা সংগ্রহই নয়, বরং বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম—অনেক সময় মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। শিল্প খাতে ইতিমধ্যেই এআইওটি শক্ত অবস্থান তৈরি করছে।
উন্নত যন্ত্রপাতি এখন পূর্বাভাস ভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ-এর মাধ্যমে আগে থেকেই সমস্যার পূর্বাভাস দিতে পারে। স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে উৎপাদনপ্রক্রিয়া আমূল বদলে যাচ্ছে। এই রূপান্তরে আইওটি হচ্ছে ‘চোখ ও কান’—ডেটা সংগ্রহ ও প্রেরণের কাজ করছে, আর এআই হচ্ছে ‘মস্তিষ্ক’—ডেটা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য এআইওটির সম্ভাবনা বিশাল। কৃষিতে স্মার্ট সেন্সর ও বুদ্ধিমান বিশ্লেষণ ফসলের উৎপাদন বাড়াতে এবং অপচয় কমাতে সাহায্য করতে পারে। তৈরি পোশাকশিল্পে—যা আমাদের অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র—এআইওটি সরবরাহ চেইনকে গতিশীল করবে, গুণগত মান নিশ্চিত করবে এবং বৈশ্বিক বাজারের স্বচ্ছতা ও টেকসইতার চাহিদা পূরণ করবে।
স্বাস্থ্যসেবায়, এআই-চালিত ওয়্যারেবল আইওটি ডিভাইস সাশ্রয়ী প্রতিরোধমূলক সেবা দিতে পারবে এবং ভীষণ চাপের মুখে থাকা হাসপাতালের বোঝা হালকা করবে। শহরে স্মার্ট ট্রাফিক ও শক্তি ব্যবস্থাপনা যানজট ও দূষণ কমাবে এবং নগরজীবনকে আরও বাসযোগ্য করবে। এগুলো কোনো দূরের স্বপ্ন নয়—সঠিক দৃষ্টি, বিনিয়োগ ও নীতির মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব।
তবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো সহজ হবে না। বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ: দুর্বল ডিজিটাল অবকাঠামো, অনির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সেসব আন্তবিষয়ক দক্ষতা গড়ে তুলতে হিমশিম খাচ্ছে, যা এআইওটি চায়।
আবার শিল্প খাত ব্যয় ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে উন্নত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে দ্বিধায় থাকে। যথাযথ পরিচালনা ব্যবস্থা ও ডেটা সুরক্ষার কাঠামো না থাকলে অপব্যবহার, বৈষম্য ও বঞ্চনা সুবিধাগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আসল পরীক্ষা তাই হলো—শুধু প্রযুক্তি গ্রহণ নয়, বরং এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করা, যেখানে উদ্ভাবন, নীতিনির্ধারণ এবং মানবসম্পদ একসঙ্গে এগোবে।
বিশ্ব যখন স্মার্ট স্বয়ংক্রিয়তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে পিছিয়ে থাকতে পারে না। আইওটি ও এআইয়ের সমন্বয় আর বিলাসিতা নয়—এটি ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম শর্ত। নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে; শিল্প খাতকে স্বল্পমেয়াদি লাভের বাইরে গিয়ে উদ্ভাবন গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে; আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরবর্তী প্রজন্মকে অভিযোজনযোগ্য দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের একটি জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে প্রযুক্তিকে চাকরি বা ঐতিহ্যের হুমকি হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতায়ন, দক্ষতা ও অন্তর্ভুক্তির হাতিয়ার হিসেবে দেখা হবে। সঠিক নীতি, প্রতিষ্ঠান ও মানসিকতার সমন্বয় ঘটাতে পারলে, এআইওটি-ই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের স্মার্ট ও সহনশীল ভবিষ্যতের দৃঢ় ভিত্তি।
এম এম শহিদুল হাসান ডিসটিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়