২০২৫ সালের ২৭ জুলাই স্কটল্যান্ডের টার্নবেরিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এক ‘প্রাথমিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি’ ঘোষণা করে। কিন্তু আসলে কোনো চুক্তি সই হয়নি। এমনকি যদি সই হতোও, সেটির খুব একটা মূল্য থাকত না। কারণ, ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদেই কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যচুক্তি করেছিলেন, কিন্তু পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি নিজেই বাতিল করে দেন।
তাই ট্রাম্পের সঙ্গে যেকোনো চুক্তিই আসলে একধরনের ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’, যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্রের এই খামখেয়ালি নেতা হঠাৎ কোনো বিষয়কে নতুন নীতিতে পরিণত করেন।
তবু টার্নবেরি চুক্তির খুঁটিনাটি মনে রাখার মতো। কারণ, সেগুলো ছিল বেশ অদ্ভুত। ইউরোপের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। আর অর্থনীতি (ক্রয়ক্ষমতার হিসাবে) কেবল সামান্য ছোট। সেই হিসাবে কোনো বাণিজ্যচুক্তি হলে সেটি আনুমানিকভাবে সমান বা ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু টার্নবেরির চুক্তি ছিল সম্পূর্ণ একপেশে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় পণ্যের ওপর অন্যায্য শুল্ক আরোপ করবে। আর ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করতে এবং মার্কিন জ্বালানি কিনতে প্রতিশ্রুতি দেবে।
কিন্তু বাস্তবে ইইউ এমন কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে না। যেমন আমি মজা করে ইইউর বাণিজ্য আলোচকদের বলেছি, ইউরোপ এখনো কোনো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি নয়। অর্থাৎ, তারা নাগরিক বা কোম্পানিগুলোকে নির্দিষ্ট বিনিয়োগ বা ক্রয় করতে বাধ্য করতে পারে না। এই সংখ্যাগুলো আসলে ট্রাম্পকে খুশি করার জন্যই দেখানো হয়েছিল, যাতে তিনি দাবি করতে পারেন যে, ‘আমেরিকা আবারও নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ব সরবরাহব্যবস্থার আরও বড় অংশ দখল করেছে।’
আন্তর্জাতিক আইন এতে লঙ্ঘিত হোক বা না হোক, ট্রাম্পের কাছে তাতে কিছু আসে যায় না। তাঁর ধারণা, ‘বড় শক্তিগুলো তো এমনটাই করে’। যেমন একটি শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রাশিয়া এটি করছে।
আমার ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হলো। এই যুদ্ধবিরতি টিকল না। মাত্র এক মাসের মধ্যে ট্রাম্প আবার ইউরোপকে হুমকি দিতে শুরু করলেন। এবার হুমকি দিলেন ইইউর ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট ও ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট নিয়ে।
এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য হলো ইউরোপের বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর নেতিবাচক প্রভাব কমানো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই আইনগুলোর মাধ্যমে ইউরোপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা ছড়ানো ও ভুয়া তথ্যের অ্যালগরিদমিক প্রচার রোধে ‘বিষয়বস্তুর পরিমিতি’ বাধ্যতামূলক করেছে। এ ছাড়া ইউরোপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সেই সব বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির ওপর কর বসাবে, যারা ব্যবহারকারীদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দিতেও পারদর্শী।
ট্রাম্প ভাবছেন, আসলে এই আইনগুলো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নয়। এগুলো ইউরোপে কার্যরত সব কোম্পানির জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
এই আইনগুলো এসেছে এক দীর্ঘ আলোচনার ও পর্যালোচনার প্রক্রিয়া থেকে। সেখানে ইউরোপীয় আইনপ্রণেতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দ্রুত বদলে যাওয়া প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন দিক ভালোভাবে বিবেচনা করেছে। অবশ্য মতানৈক্যও ছিল। অনেকে বলেছিলেন, নিয়মগুলো অতিরিক্ত কঠোর। কিন্তু অনেকের মতো আমি উল্টো মনে করি। আমি মনে করি, নিয়মগুলো যথেষ্ট কঠোর নয়।
প্রযুক্তি জায়ান্টরা এখনো অত্যধিক বাজারক্ষমতা ধরে রেখেছে। তারা কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারকে এখনো লঙ্ঘন করছে। এর ফলে ইউরোপীয় সমাজ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এখন ইউরোপের সামনে মূল প্রশ্ন হলো:
তারা কি প্রযুক্তি-অলিগার্কদের দ্বারা পরিচালিত এক স্বেচ্ছাচারী, জনতুষ্টিবাদী নেতার চাপে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক নীতিকে ত্যাগ করবে?
ট্রাম্প বারবার দেখিয়েছেন, তিনি নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ ধনকুবের সমর্থকদের স্বার্থে কাজ করেন, আমেরিকার জনগণের নয়। আর ইউরোপের স্বার্থের তো নয়ই।
আমরা এখন এতটাই অভিজ্ঞ যে জানি, একবার নতি স্বীকার করলে পরবর্তী সময়ে ট্রাম্পের দিক থেকে আরও বড় আবদার আসবে।
তাই ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিগত আবেগ, ভুল অর্থনৈতিক ধারণা ও অপূরণীয় ক্ষোভে চালিত এক প্রেসিডেন্টরূপী রাজার সঙ্গে আপস করার কোনো মানে হয় না। ইউরোপের মূল্যবোধ এত সস্তা নয় যে তা বেচে দেওয়া যায়।
হ্যাঁ, ট্রাম্পের বিরোধিতা করলে কিছু স্বল্পমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে সেই সব প্রতিষ্ঠানের জন্য এই ক্ষতি হতে পারে, যারা মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম বলছে, বাণিজ্যে লাভ তখনই হয়, যখন তা ন্যায্য শর্তে হয়। আর ট্রাম্প যা করছেন, তা হলো বিশ্ব সরবরাহ চেইন থেকে যতটা সম্ভব মূল্য ‘নিংড়ে নেওয়ার’ চেষ্টা। এতে ইউরোপের লাভ কমে গিয়ে উল্টো ক্ষতিতেও পরিণত হতে পারে।
আসলে ইউরোপের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী। সে ট্রাম্পের শুল্কনীতি সামলাতে পারবে। বিশেষ করে এখন, যখন ইউরোপ ইউক্রেন যুদ্ধে জেতার জন্য সামরিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, তখন বোঝা যাচ্ছে এই ধাক্কা তারা সামলাতে পারবে।
আর মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পকে মেনে চলার চেয়ে তাঁর বিরোধিতা করায় মাশুল অনেক কম দিতে হবে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে নীতি (যেখানে ‘আইনের শাসন’ ছিল মূল ভিত্তি), সেই নীতিই বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
আইনের শাসন ভেঙে গেলে বাজার আর ন্যায়সংগত বা কার্যকর ফল দেয় না। বিনিয়োগ কমে যায়, প্রবৃদ্ধি থেমে যায় আর গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যখন ট্রাম্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, ট্রাম্প তখন পিছু হটেছিলেন।
আর সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভাও বলেছেন, সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের মতো কিছু বিষয় কখনোই আপসযোগ্য নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও তাই করা উচিত। তাকে নিজের নীতি, সম্মান ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য অটল থাকতে হবে।
জোসেফ ই. স্টিগলিৎজ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ