অভিনেত্রী মাহিয়া মাহিকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে, কারাগারে পাঠানোর সাড়ে ৫ ঘণ্টার মধ্যে তিনি ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু এই মামলার আসামি মাহিয়া মাহি না হয়ে অন্য কেউ হলে তাঁকে হয়তো মাসের পর মাস কারাগারেই পস্তাতে হতো। কারাগারে যাওয়ার আগে রিমান্ডে নিয়ে হয়তো পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায় করত। ৭ দিন কেন এ রকম ‘দুর্ধর্ষ’ আসামিকে ৭০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করতে পারেন আমাদের অতি দক্ষ আইনপ্রয়োগকারীরা।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের করা মামলায় বিমানবন্দর এলাকা থেকে মাহিয়া মাহিকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর মহানগর পুলিশ। একই মামলার আসামি তাঁর স্বামী রকিব সরকারকে পুলিশ পলাতক দেখিয়েছে। যদিও তিনি রোববার দেশে ফিরেছেন।
গ্রেপ্তারের পর শনিবার দুপুরে গাজীপুর আদালতে নিয়ে মাহিয়া মাহির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালতের বিচারক রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মাহিয়া মাহির আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন।
গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শনিবার রাতে শহরের তেলিপাড়া এলাকায় একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে মহিয়া মাহি বলেন, তিনি এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাঁর নাম মোল্যা নজরুল ইসলাম (গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার), গোটা পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। লাইভে যাওয়ার প্রসঙ্গে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘লাইভে মানুষ কখন যায়, যখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। আমাদের শোরুমটা দখল হয়ে যাচ্ছিল। ফেসবুকে যে ভিডিওটা আপলোড করেছি, তাতে আছে, লাঠি-পাইপ নিয়ে আমাদের শোরুমে আসছে দখলের উদ্দেশ্যে।’
গ্রেপ্তার ও কারাগারে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে মাহিয়া মাহি বলেন, ‘আমাকে এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পুলিশ থেকে শুরু করে গাজীপুরের পুলিশ কারাগারে দিয়েছে—এ পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা অনেক খারাপ। তারা আমাকে যেভাবে ট্রিট করেছে তাতে মনে হয়েছে, আমি একজন যুদ্ধাপরাধী। হ্যাঁ, আমি একটা লাইভ করেছি, আমি একজনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, সে ডিজিটাল আইনে মামলা করেছে। কিন্তু আমি তো কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী নই। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমাকে গাড়িতে নেওয়ার সময় ওয়্যারলেসেও কথা বলছিলেন না পুলিশ সদস্যরা, যাতে অন্যরা আমার অবস্থান বুঝতে না পারেন। গাড়িতে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলাম, তাঁরা আমাকে পানিও দিয়েছেন এক ঘণ্টা পর।’
অন্যদিকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামের অভিযোগ, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ও তাঁর স্বামী রকিব সরকার অপমান, অপদস্থ ও হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিথ্যা, বানোয়াট, আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকার তথ্য প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর অপরাধ করেছেন। এ কারণে শুক্রবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁদের নামে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটনের বাসন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ রোকন মিয়া। একই দিনে তাঁদের আসামি করে গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী আরেকটি মামলা করেছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার অপমানিত বোধ করলেন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেন বাসন থানার উপপরিদর্শক। ঊর্ধ্বতনেরা চাইলে অধস্তনদের অনেক কিছু করতে হয়। দিনকে রাত বানাতে হয়।
গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম আউটপাড়া এলাকায় প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের জমি নিয়ে ইসমাইল হোসেন নামে এ ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ মাহির স্বামী রাকিবের। ইসমাইল হোসেন দাবি করেন, রকিব সরকার ওই জমি দীর্ঘদিন ধরে জবরদখল করে রেখেছেন। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয় রকিবের গাড়ির শোরুম। এরপর স্বামী রকিব সরকারের সঙ্গে ওমরাহ পালন করতে যাওয়া মাহিয়া মাহি গত শুক্রবার ফেসবুক লাইভে এসে পুলিশসহ নানাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
সরকারের পক্ষ থেকে দোহাই দেওয়া হয়, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কেউ অপরাধ করতে না পারে, সে জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ আইন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে ভিন্নমত প্রকাশের বিরুদ্ধে। এই আইনে নিরীহ ও নিরাপরাধ মানুষই বেশি নিগৃহীত হচ্ছেন।
লাইভে মাহিয়া মাহি অভিযোগ করেন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন দেড় কোটি টাকা ‘ঘুষ’ নিয়ে প্রতিপক্ষকে দিয়ে জমি দখল করিয়ে দিচ্ছেন। অভিযোগের বিষয়ে মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি মিথ্যা বলে মানুষের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করেছেন। এ কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশ বাদী হয়ে রকিব ও মাহির নামে মামলা করেছে।
মাহিয়া মাহি ও তাঁর স্বামী রকিব সরকারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ ইসমাইল হোসেনের। সেই বিরোধে পুলিশের কোনো পক্ষ নেওয়ার কথা নয়। মাহিয়া মাহির অভিযোগ অনুযায়ী গাজীপুর পুলিশ ইসমাইল হোসেনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। এ অভিযোগ সত্য না হলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা মানহানির মামলা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। কেননা এটি এমন একটি আইন যাতে জামিন পাওযা কঠিন।
মামলার বাদী আসামিকে গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সাত দিনের রিমান্ডও চেয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার কী ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, মাহিয়া মাহির ঘটনা তার প্রমাণ। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী বিমানবন্দরে নামতেই তাঁকে পাকড়াও করে গাড়িতে তুলে নেয় গাজীপুর পুলিশ। এরপর আদালতে হাজির করে। মাহিয়া মাহি কি দুর্ধর্ষ কোনো সন্ত্রাসী? তিনি যে অন্তঃসত্ত্বা, তা পুলিশ জানে না? তাঁকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে চাওয়ার আবেদন কী করে করতে পারল পুলিশ?
মাহিয়া মাহিকে এভাবে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দেশের সবার মধ্যে একটা ভয়ের বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করছেন পরিচালক কাজী হায়াৎ। তিনি বলেন, ‘এভাবে গ্রেপ্তারের বিষয়টা ভয়ের বিষয়। আতঙ্কের বিষয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে দোহাই দেওয়া হয়, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কেউ অপরাধ করতে না পারে, সে জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ আইন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে ভিন্নমত প্রকাশের বিরুদ্ধে। এই আইনে নিরীহ ও নিরাপরাধ মানুষই বেশি নিগৃহীত হচ্ছেন।
কয়েক দিন আগে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। এর আগেও তিনি আইনটি সংশোধন ও পরিমার্জনের কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল করা প্রয়োজন। এই আইনে মামলা করে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজলের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল। এখনো তিনি আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। মাঝখানে কয়েক মাস ‘গুম’ হয়ে গিয়েছিলেন। এ আইনে গ্রেপ্তার মানবাধিকারকর্মী মোশতাক আহমদ কারাগারেই মারা গেছেন। কার্টুনিস্ট কিশোরসহ বহু নিরাপরাধ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হবে না। আগে মামলার গুণাগুণ বিচার করে দেখা হবে। কিন্তু সেই গুণাগুণ বিচার যাঁরা করবেন, তাঁরা তো গাজীপুর মেট্রোপলিটান পুলিশের মতো লোকজনই। পুলিশ মাহিয়া মাহির রিমান্ড দাবি করেছেন, সত্য উদঘাটনের জন্য নয়। যে আইন ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠী রোষের হাতিয়ার হয়, সেই আইন সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]