চীন যেভাবে ব্রহ্মপুত্র ও অন্য নদীকে অস্ত্র করছে

ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ একটি স্পষ্ট হুমকি।ছবি : রয়টার্স

২০২৫ সালের জুলাইয়ে চীন যখন ইয়ারলুং সাংপো (ব্রহ্মপুত্রের তিব্বতি নাম) নদীতে মেগা ড্যাম নির্মাণ শুরু করে, তখন এটি জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন থেকে কৌশলগত নদী নিয়ন্ত্রণের দিকে আরেকটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। তিব্বতের শহর নিংচিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং আনুষ্ঠানিকভাবে ওই প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন।

এই প্রকল্পে পাঁচটি ধাপে নির্মিত জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থাকবে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ গিগাওয়াট। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম একে সবুজ প্রকৌশলের একটি বিস্ময় হিসেবে তুলে ধরলেও ভাটির দেশগুলো এটিকে বেইজিংয়ের পানি আধিপত্যের স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছে। এই প্রকল্প এশিয়ার আন্তসীমান্ত নদীগুলোকে অস্ত্রে পরিণত করতে পারে এবং তাদের পানিনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

পানিসম্পদের আধিপত্য

তিব্বত মালভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ চীনকে নজিরবিহীন পানি কৌশলগত প্রভাব দিয়েছে। এই মালভূমি থেকেই এশিয়ার ১০টি বড় নদীর উৎপত্তি। ইয়ারলুং সাংপো প্রকল্পটি পশ্চিম চীন থেকে পূর্ব চীনে বিদ্যুৎ স্থানান্তরের নীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং একই সঙ্গে আন্তসীমান্ত পানিসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার একটি হাতিয়ার। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছে। চীনা কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এতে ভাটির দেশগুলোর কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়নি, যা সাধারণত এ ধরনের প্রকল্পে নিয়মিতভাবে করা হয়।

তিব্বতের নির্বাসিত সরকার এই প্রকল্পকে পরিবেশগত হুমকি হিসেবে নিন্দা করেছে এবং বলেছে এটি কোটি মানুষের পানিনিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। জেনেভায় তাদের দপ্তর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে সতর্ক করে জানিয়েছে, এই বাঁধ তিব্বতের নাজুক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পানিনিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে। তিব্বতের অ্যাকটিভিস্টরা জানিয়েছেন, ২০০০ সাল থেকে মালভূমিতে বাঁধ নির্মাণের কারণে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৫১ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পরিকল্পিত ১৯৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আরও প্রায় ১২ লাখ মানুষ উচ্ছেদের মুখে পড়তে পারে।

ঝুঁকিতে ভারত ও বাংলাদেশ

ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ একটি স্পষ্ট ও তাৎক্ষণিক হুমকি। এই নদী অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং এবং আসামে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রবেশের পর এটি যমুনা নামে প্রবাহিত হয়। নদীটি ভারতে ভাটিতে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের জীবিকার উৎস এবং বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে টিকিয়ে রাখে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সব উন্নয়ন খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং চীনকে আহ্বান জানিয়েছে যেন ভাটির দেশগুলোর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জুলাই মাসে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার বৈঠকে সরাসরি চীনা কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন।

এই কৌশলগত ঝুঁকি খুবই স্পষ্ট। মেকং নদীতে চীনের নির্মিত ১২টি ধাপে বাঁধ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভাটিতে পানির প্রবাহ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্রহ্মপুত্রকে একটি জলবোমায় পরিণত করতে পারে, যেখানে হঠাৎ পানি ছেড়ে দিলে আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু সতর্ক করে বলেছেন, এই বাঁধ তাঁদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকায় গুরুতর হুমকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি। ব্রহ্মপুত্র মেঘনা গঙ্গা অববাহিকার মাত্র সাত শতাংশ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত। ফলে দেশটি পুরোপুরি উজানের দেশগুলোর সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিংয়ের কাছে প্রকল্পের কারিগরি তথ্য ও পরিবেশগত মূল্যায়ন চেয়েছে। কিন্তু এর জবাবে কেবল পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার অস্পষ্ট আশ্বাসই পেয়েছে।

পলিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়াও আরেকটি অস্তিত্বগত হুমকি। ব্রহ্মপুত্র নদ প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি ১০ লাখ টন পলি বহন করে, যা বাংলাদেশের বদ্বীপকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ধান উৎপাদন টিকিয়ে রাখে। চীনের বাঁধগুলো এই পুষ্টিসমৃদ্ধ পলি আটকে দিতে পারে, যার ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বদ্বীপ অঞ্চলের ভূমি দ্রুত দেবে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা মেকং নদীর সঙ্গে সরাসরি তুলনা টানেন, যেখানে চীনের বাঁধগুলো প্রায় ৩০ শতাংশ পলি আটকে রেখেছে এবং এর ফলে ভিয়েতনামের বদ্বীপে গুরুতর সংকট তৈরি হয়েছে।

বিপদের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে

ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীনের কৌশল অনেকটাই মেকং নদীতে অনুসৃত নীতির প্রতিচ্ছবি, যা এশিয়ার আন্তসীমান্ত নদী ব্যবস্থার জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। মেকং নদীতে চীন মূল প্রবাহে ১২টি বাঁধ পরিচালনা করছে, যেখানে অববাহিকার ব্যবহারযোগ্য পানির প্রায় ৫০ শতাংশ মজুত করা হয়। ২০১৬ সালে যখন ভিয়েতনামসহ আশপাশের অঞ্চলে তীব্র খরা চলছিল, তখন চীন উজানের নদী থেকে নিজের ইচ্ছামতো পানি নিয়ন্ত্রণ ও ছেড়ে দেয়। এই একতরফা সিদ্ধান্তের ফলে ভাটির দেশ ভিয়েতনামে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম পানি পৌঁছায়।

ভিয়েতনামের বিজ্ঞানীরা গবেষণা ও তথ্যের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, চীনের এই আচরণই ভাটিতে পানির সংকটকে আরও গুরুতর করে তোলে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় সরকারকে শেষ পর্যন্ত চীনের কাছে জরুরি ভিত্তিতে পানি ছাড়ার অনুরোধ জানাতে হয়। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় চীনের কাছে বিপুল ঋণগ্রস্ত লাওস ও কম্বোডিয়া একই মডেল অনুসরণ করেছে। তারা ৮১টি উপনদীতে বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা কম্বোডিয়ার মৎস্যসম্পদ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।

এই ধারা অন্যান্য নদীতেও বিস্তৃত। ইরাবতী ও সালউইন নদীতে চীনের বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম মিয়ানমারের ভাটির পরিবেশব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলছে। মধ্য এশিয়ার নদীগুলোও একই ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলধারা সনদে যোগ দিতে বা বাধ্যতামূলক পানিবণ্টন চুক্তি করতে চীনের অস্বীকৃতি একটি আইনি শূন্যতা তৈরি করেছে, যা একতরফা শোষণের সুযোগ করে দিচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ২০০৬ সালে গঠিত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যবস্থাটি কেবল বন্যা মৌসুমে জলবিদ্যুৎ–সংক্রান্ত তথ্য আদান–প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতে বাঁধ পরিচালনা বা কৌশলগতভাবে পানি আটকে রাখার বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই।

জবাবদিহির ঊর্ধ্বে

চীনের ব্রহ্মপুত্রকেন্দ্রিক পদক্ষেপগুলো যদি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকে, তবে এর প্রভাব পুরো এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। এই প্রকল্প পানি আধিপত্যকে রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধ কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। এর ফলে ভাটির দেশগুলো পাল্টা বাঁধ নির্মাণে উৎসাহিত হতে পারে, যেমন ভারতের প্রস্তাবিত ১১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার সিয়াং আপার বহুমুখী প্রকল্প। এতে নদী ব্যবস্থাগুলো আরও খণ্ডিত হবে। এই বাঁধ নির্মাণের প্রতিযোগিতা পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়াবে এবং এতে উজানে চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো মূল সমস্যাটি উপেক্ষিতই থেকে যাবে।

২০২৫ সালে জাতিসংঘের পানি সনদে যোগদান করেছে বাংলাদেশ। এই যোগদান দেশটির আলোচনাগত অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে করা হলেও, এটি চীন ও ভারতের মধ্যে পানিকে ঘিরে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করতে পারে। এর মাঝখানে বাংলাদেশ পড়ে যাবে দুটি প্রভাবশালী শক্তির প্রকল্পের চাপে। তিব্বত মালভূমি থেকে ভাটিতে বসবাসকারী প্রায় ১৮০ কোটি মানুষের সামনে এমন এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, যেখানে পানি আর যৌথ সম্পদ থাকবে না, বরং চাপ সৃষ্টির হাতিয়ারে পরিণত হবে।

বহুপক্ষীয় সংযম

ইয়ারলুং সাংপোর নিম্ন প্রবাহে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এশিয়ার পানিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি নির্ধারক মুহূর্ত তৈরি করেছে। বেইজিংয়ের কৌশল হলো আগে নির্মাণ করা, পরে আলোচনা করা এবং স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠলে সার্বভৌমত্বের অজুহাত দেখানো। এটি আন্তসীমান্ত নদী নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার অভাব এবং পানির প্রবাহের ওপর চীনের কার্যত ভেটো ক্ষমতা কোটি কোটি মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আন্তর্জাতিক পানি আইনের ভিত্তিতে দ্রুত বহুপক্ষীয় উদ্যোগ না নেওয়া হলে এশিয়ার ভবিষ্যৎ এমন এক দিকে যাবে, যেখানে নদী আর জীবনধারা থাকবে না, বরং ভূরাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের অস্ত্রে পরিণত হবে। ব্রহ্মপুত্র কেবল পরবর্তী পরীক্ষামাত্র। নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চীনের জলভিত্তিক সাম্রাজ্য পুরো মহাদেশের নদী ব্যবস্থায় তার প্রভাব বিস্তার করবে।

• চন্দু দোদ্দি, গবেষক সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি

দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত