এদিকে খেই হারানো বাইডেন, ওদিকে স্বৈরাচার ট্রাম্প

টিভি বিতর্কে মুখোমুখি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনছবি: এএফপি

টিভি বিতর্কে জো বাইডেন কী বলেছেন, সেটি বড় ব্যাপার ছিল না, তিনি কীভাবে বলেছেন, সেটাই মুখ্য বিষয়। তাঁর গলার স্বর ছিল খুব দুর্বল। বারবার তিনি কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি কী বিষয়ে কথা বলছেন, তা–ও বারবার ভুলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে অতি বার্ধক্যজর্জর দুর্বল মানুষ মনে হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম টিভি বিতর্কে অংশ নেওয়ার পর বাইডেন এমনই বিব্রতকর ও বিপর্যয়কর অবস্থার মুখে পড়েছিলেন।

বিতর্কের পর মিত্র ও শত্রু উভয় শিবির থেকে উত্তপ্ত সমালোচনার ঝড় বাইডেনের সাদা চুলের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এই বিতর্কে তাঁর যে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে, তা সত্যিই বেদনাদায়ক ছিল।

বিতর্কের দিন রিপাবলিকান শিবির খুবই উল্লসিত ছিল। বিতর্কের পর তারা মনে করছে, ভোটের সব শেষ হয়ে গেছে। তারা বলছে, টিভি বিতর্কে বাইডেনের লক্ষ্য ছিল একটাই। সেটা হলো, ৮১ বছর বয়সে এসেও তিনি যে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিকভাবে ঠিক আছেন, এটি প্রমাণ করা। কিন্তু তাতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।

রিপাবলিকানদের এই ধারণায় অনেক আমেরিকানই একমত হবেন। তবে বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে বাইডেনের ধরাশায়ী হওয়ার বিষয়টি দোদুল্যমান ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

বিতর্কের পর অনেকেই বলছেন যে বাইডেনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে প্রচণ্ড আত্মগৌরবে ভুগতে থাকা একগুঁয়ে বাইডেনকে বসিয়ে দেওয়ার যেকোনো চাপ তিনি প্রতিহত করবেন। তিনি কিছুতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।

ডেমোক্র্যাটদের প্রথম সারির নেতারা যে মুখ ফুটে বাইডেনকে সরে দাঁড়াতে বলবেন, সেটিও কারও পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি পাল্টে যেতেও পারে।

আমেরিকার জন্য এটি নিঃসন্দেহে তীব্র নির্বাচনী সংকটের একটি মুহূর্ত। তবে বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের পুনর্নির্বাচনের আশাকে কবর দেওয়ার আগে বিশ্বের একটু বিরতি নেওয়া ও গভীর শ্বাস নেওয়া উচিত।

বিতর্কের গোলমালের মধ্যে ট্রাম্পের নিজের জঘন্য পারফরম্যান্সও ঢাকা পড়ছিল। তাঁকে যতটা না প্রেসিডেন্টের মতো দেখাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছিল শিকারির মতো। তাঁকে যতটা না প্রার্থী মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি ঘৃণ্য উত্পীড়ক মনে হচ্ছিল।

বিতর্ক অনুষ্ঠানটি শুধু যে ট্রাম্পের অপরিবর্তিত চরিত্র ও অসংলগ্ন আচরণকেই সামনে আনেনি বরং এটি আমেরিকার সংবিধানের সেই সব ত্রুটি তুলে ধরেছে, যা ট্রাম্পের মতো নিচু স্তরের লোককে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পদ স্পর্শ করতে সক্ষম করেছে। সুতরাং বলা যায়, এই সংকটের জন্য ট্রাম্প একা দায়ী নন, আমেরিকার সাংবিধানিক কর্মপদ্ধতিও এর জন্য দায়ী।

তিনি কোনো ধরনের সংকোচ ছাড়াই অবলীলায় একের পর এক মিথ্যা বলে গেছেন। তাঁর কাছে সব নীতিই হলো কুসংস্কার। মানুষটি যে কত বিপজ্জনক, তার সময়োপযোগী অনুস্মারক হয়ে রইল এই বিতর্ক।

ট্রাম্পের আক্রমণ ও আঘাতগুলো বাস্তবতাবিবর্জিত ভিত্তিহীন বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি দাবি করেন যে বাইডেন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চীনের কাছ থেকে তিনি নাকি পয়সাকড়ি নিয়েছেন। কিন্তু এ কথার সমর্থনে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি।

ট্রাম্প বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের ঢেউ অভূতপূর্ব মাত্রায় ‘আমাদের নাগরিকদের ওপর আছড়ে পড়ছে এবং আমাদের হত্যা করছে’। এই কথাও ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক।

ট্রাম্পের সবচেয়ে হাস্যকর বক্তব্য ছিল, বাইডেন নাকি রাশিয়াকে ইউক্রেনে হামলা চালাতে ‘উৎসাহিত’ করেছিলেন। অথচ সবাই জানেন যে ট্রাম্প বরাবরই ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করে থাকেন। সবাই জানেন, ট্রাম্প পুতিনের মতোই স্বৈরশাসক হতে চান।

এই বিতর্ক দুটি জিনিস প্রমাণ করেছে। একটি হলো, বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য প্রচণ্ড সংগ্রাম করছেন। একটি দুঃখজনক ও বিব্রতকর অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর এবং নিঃস্বার্থ অবস্থানে নিজেকে ধরে রাখার যে বোধ তাঁর থাকার কথা ছিল, সেটার অভাব দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

আরেকটি বিষয় হলো, নীতি ও যোগ্যতার ঘাটতিতে ভোগা ট্রাম্প হলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি নির্বাচিত হওয়ার জন্য কোনো কিছুরই পরোয়া করবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি যদি ওভাল অফিসে ফিরে যান, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে প্রতিহিংসার রাজত্ব কায়েম করবেন।

এই বিতর্ক আমাদের দেখিয়েছে যে ট্রাম্পকে নিয়ে আবারও গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মিথ্যাচার, অপরাধ, গণতন্ত্রবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্বৃত্তায়ন ও বর্ণবাদী অভিবাসনবিরোধিতা উত্তরোত্তর প্রকাশিত হয়েছে।

২০২০ সালে ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পর উদারপন্থীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছিল এবং তাঁদের ওপর একধরনের আত্মতুষ্টি ভর করেছিল।

কিন্তু জরিপ দেখাচ্ছে যে তিনি বেশ জোরেশোরেই ফিরে এসেছেন। সত্যি বলতে, আদতে তিনি কখনোই দূরে যাননি। অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়, নভেম্বরের নির্বাচনটি যদি আজ অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে সম্ভবত ট্রাম্পই জয়ী হতেন।

তবে ট্রাম্পের ফিরে আসার প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে বুঝতে হলে তাঁর হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তাঁর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করা জন কেলির সাক্ষ্য বিবেচনা করা যেতে পারে। ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউসে ছিলেন, তখন প্রতিদিন খুব কাছ থেকে তাঁকে জন কেলি দেখেছেন।

কেলি তাঁর সাবেক বস ট্রাম্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘নারী, সংখ্যালঘু, ধর্মপ্রচারক খ্রিষ্টান, ইহুদি, কর্মজীবী পুরুষ-নারী এমনকি অনাগত জীবনের বিষয়ে তাঁর অবস্থান সত্যনিষ্ঠ নয়।’ কেলি বলেন, ‘আমেরিকা কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই। তিনি স্বৈরাচারী ও খুনি স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আমাদের সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

বিতর্ক অনুষ্ঠানটি শুধু যে ট্রাম্পের অপরিবর্তিত চরিত্র ও অসংলগ্ন আচরণকেই সামনে আনেনি বরং এটি আমেরিকার সংবিধানের সেই সব ত্রুটি তুলে ধরেছে, যা ট্রাম্পের মতো নিচু স্তরের লোককে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পদ স্পর্শ করতে সক্ষম করেছে। সুতরাং বলা যায়, এই সংকটের জন্য ট্রাম্প একা দায়ী নন, আমেরিকার সাংবিধানিক কর্মপদ্ধতিও এর জন্য দায়ী।

বিতর্কের আগে থেকেই বাইডেনের অবস্থা নড়বড়ে ছিল। গত সপ্তাহের একটি জরিপে ট্রাম্প জাতীয় পর্যায়ে তিন পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন। সাতটি কি সুইং স্টেটেই তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাইডেনকে এগিয়ে আসতে হলে নভেম্বরের মধ্যে ছোটখাটো একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটতে হবে।

তবে বাইডেনের বিকল্পটি একেবারেই ভয়ংকর। এক পণ্ডিত যেমন বলেছেন, ভোটারদের এখন একজন বৃদ্ধ ও একজন বাটপার—এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে।

● সাইমন টিসডাল দ্য অবজারভার–এ পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত