পিছিয়ে পড়া উত্তরাঞ্চলের প্রকল্পের বাস্তবায়ন জরুরি

শরীরের একটি অংশ অঙ্গহীন হয়ে পড়লে যেমন পুরো শরীর তার ব্যথা বহন করে, তেমনি একটি দেশের বৃহত্তর অঞ্চল যদি অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর হয়, তাহলে সেই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমনটি আমরা পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।

আবার শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে সরকার কলম্বোতে বিশাল অঙ্কের টাওয়ার স্থাপন করলেও অন্যান্য অঞ্চল অনুন্নত থাকার কারণে দেশটি অর্থনীতিতে ধসে গেছে। ব্যাষ্টিক অর্থনীতি যেমন একটি ব্যক্তি, একটি প্রতিষ্ঠান বা একটি ফার্মের কথা বলে, বিপরীতে সামষ্টিক অর্থনীতি একটি স্থান বা এলাকা, একটি ব্যক্তি বা ফার্মের কথা না বলে দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। সে কারণেই সারা দেশের অগ্রগতির জন্য আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও কাঠামোগত অবস্থা আগের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছিল। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন রুটির ঝুড়ি’ কথাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর থেকে এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু বার্ষিক বরাদ্দ বণ্টন এবং মেগা প্রকল্পের অভাবে পিছিয়ে পড়েছে উত্তরের জনপদ ও জনজীবন। রয়ে গেছে জীবনযাত্রার নানান বৈষম্য।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও পিছিয়ে রয়েছে উত্তরাঞ্চল। রংপুরের বর্তমান ডিসি মহোদয়ের মতে, রংপুর বিভাগের উন্নয়নমূলক কাজ অন্য জেলার উন্নয়নমূলক কাজের থেকে অনেক কম হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে বিভাগীয় জনসভায় ২৭টি প্রকল্পের কথা বলেছেন। নিঃসন্দেহে সেটি প্রশংসনীয় এবং আমাদের জন্য আশার আলো। এসব প্রকল্পের কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনমান, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে, যদি সেগুলো সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা হয়। তার জন্য প্রয়োজন বাজেটের বাইরেও অতিরিক্ত বাজেট প্রণয়ন এবং কাঠামোগত পরিবর্তন।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জেলাগুলোর মধ্যে রংপুর বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে ছয়টি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় জীবন যাপন করছে; তার মধ্যে কুড়িগ্রাম চরমভাবে দরিদ্র এলাকা। অর্থনৈতিক মন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ফসলের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় উত্তরবঙ্গ; তার মধ্যে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলা সর্বাধিক ক্ষতির স্বীকার হয়।

প্রতিবছর তিস্তার পানিবণ্টনে অব্যবস্থাপনার কারণে বন্যায় কয়েক লাখ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করায় ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয় উত্তরবঙ্গ। চলতি বছর ১৪ আগস্টের পাওয়া খবর অনুযায়ী, আবারও ঘণ্টায় প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়েছে ভারত।

এই পানি নেমে আসা শুরু করেছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলা হয়ে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত আসা পানির কারণে সৃষ্ট বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। একটি জরিপে দেখা গিয়েছে, প্রতিবছর শতকোটি টাকার পরিমাণ ফসলাদির ক্ষতি হচ্ছে৷

অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড খরা দেখা দেয়। নদীর পানি চলে যায় তলানিতে, এ কারণে সেচের মাধ্যমে আমন ধানে প্রচুর পানি দিতে হয়। এতে করে বৈদ্যুতিক খরচ বেড়ে যায়, কোথাও কোথাও ডিজেলচালিত শ্যালোমেশিনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করতে হয়। যেহেতু কয়লা ও তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেটি অর্থনীতির নিম্নগামিতায় একটা বড় প্রভাব ফেলে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং পানিবণ্টন সমঝোতা করলে বার্ষিক উৎপাদনের হার কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সঙ্গে বৈদ্যুতিক খরচও কমে যাবে। এ ছাড়া প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলার করাল গ্রাসে হাজার হাজার একর চাষাবাদের জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, বিলীন হচ্ছে শত শত গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই নদী শাসন করা একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছে।

উত্তরবঙ্গের উন্নতি প্রকল্পে সিরামিকশিল্প স্থাপন এবং কুড়িগ্রামে ইপিজেড প্রদান করা প্রয়োজন। সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে চিলমারীর রাস্তাটির কাজ সম্পন্নকরণ; হরিপুর-চিলমারী ব্রিজের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন হলে কুড়িগ্রামের সঙ্গে ঢাকাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ সহজতর হবে এবং এতে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে। একই সঙ্গে কুড়িগ্রামের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসহ, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে স্থলভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থারও বিস্তৃতি ঘটবে।

স্বাধীনতা-উত্তর রংপুর বিভাগে ২০২০ সাল পর্যন্ত একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি সরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্প্রতি নতুন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এবং তাদের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে ও হবে, যা কিছুটা হলেও উত্তরের জনপদের মানুষের দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়।

আরও নতুন কিছু অনুষদ, যেমন জীববিজ্ঞান, ফার্মেসি, আইন অনুষদ এবং নতুন গবেষণা ইনস্টিটিউট খোলা একান্ত জরুরি। সঙ্গে আবাসিক ও মেডিকেল সুবিধা বৃদ্ধি এবং ড. এস ওয়াজেদ ইনস্টিটিউটের কাজ সম্পন্নকরণ প্রয়োজন। এ ছাড়া বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন।

উত্তরের জনপদের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে শুধু বার্ষিক বরাদ্দ ও মেগা প্রকল্পের ঘোষণা নয়, বরং সেগুলোর ঠিকঠাক তদারকি এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। এতে উত্তরবঙ্গের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল অবস্থা থেকে বেরিয়ে উন্নত দেশের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।

নুর আলম সিদ্দিক
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর