বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তিকে কেন তারা ‘তুচ্ছ’ মনে করছে

‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বারবার তাগাদায়ও যদি ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় এবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় না আসে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে এখনো সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে রয়েছে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আগের বছর ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নিলেও এবার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্রণোদিত হয়ে ‘শিক্ষার মান’ উন্নয়নের তাগিদে এককভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে বলে এরই মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।

কয়েক মাস ধরে ‘গুচ্ছ ভর্তি’ পরীক্ষা নিয়ে দোলাচলের মধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্মারকলিপির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিনবার উপাচার্যদের চিঠি দিয়ে ‘গুচ্ছ ভর্তি’ পরীক্ষার অনুরোধ জানিয়েও কাজ হয়নি।

সর্বশেষ গত সপ্তাহে চতুর্থবারের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উপাচার্যদের চিঠি পাঠিয়ে কড়া ভাষায় বলা হয়েছে, দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘স্বার্থ ও দাবি’ বিবেচনা করে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম ‘কঠোরভাবে’ মেনে চলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ‘নির্দেশ’দেওয়া হলো।

যদিও এই ‘নির্দেশ’ দেওয়ার কয়েক দিন পার হলেও গুচ্ছ থেকে বের হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৃশ্যত কোনো সাড়া চোখে পড়েনি; বরং গুচ্ছকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি সাড়ছে। ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘অটোনোমাস’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাচর্চা করছে, সেখানে ভর্তি-ইচ্ছুক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেউ নয়। নিজেদের একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তকে বড় করে দেখছে তারা।

কিন্তু এটা কি হওয়ার কথা ছিল? কেন তারা গুচ্ছ থেকে এক সারিতে দাঁড়াতে চাচ্ছে? গুচ্ছের সমস্যাগুলো কী ছিল? কয়েক বছর ধরে গুচ্ছে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাবি করে আসছে যে তারা কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছে না। যোগ্য ও মেধাবীদের বেছে নিতে না পারার দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমছে।

আসলে কি তা–ই? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ঠিক কোন যোগ্যতাকে তারা ‘মেধার’ মাপকাঠিতে ফেলাতে চায়? একটি বইয়ের গৎবাঁধা কিছু প্রশ্ন, যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করে ‘ভর্তি পরীক্ষায় উগরে’ দিতে পারলে কি মেধার স্বাক্ষর নিশ্চিত করা যায়? যদি সেটাই হয়, তাহলে যে শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হন, দ্বিতীয় হন; সেই শিক্ষার্থী পরবর্তী সময় স্নাতকে প্রথম হন? দ্বিতীয় হন?
না, হন না।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যাঁরাই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করেন, পরবর্তী সময় শিক্ষাজীবনে তাঁরা যে ভালো করবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারেন না। ভর্তি পরীক্ষা কখনোই মেধাযাচাইয়ের ক্ষেত্র নয়, এটা নিছক একটি প্রতিযোগিতা। অনেকটাই দৌড় প্রতিযোগিতার মতো। সবাই দৌড়ায়, কিন্তু দিন শেষে কয়েক সেকেন্ডের তফাতে চূড়ান্ত ফিতায় ছুঁতে পারেন একজনই। আর এভাবে চলে আসে প্রতিযোগিতার ভগ্নাংশ। ভর্তি পরীক্ষাকে তাই যাঁরা মনে করছেন ‘বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতা’ পরিমাপের মানদণ্ড, তাঁরা দয়া করে নিজেদের সংশোধন করে নিন। সেটাই যদি হয়, তাহলে বিশ্ব পরিমণ্ডলের র‍্যাঙ্কিং আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মান’ বের করা যেত।

আমরা যদি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই নিজেদের বড় বিশ্ববিদ্যালয়, দামি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাবি করি, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক কেন, এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারত।

সুতরাং ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কোনো ইগোয়েজিম দেখানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিম্ন মানসিকতার পরিচয় বহন করে। মনে রাখতে হবে, আপনাদের নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় না; বরং জনগণের করের টাকার ওপর নির্ভর করে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হয়। তাই সরকারের কথাকে গুরুত্ব না দেওয়া কিংবা উপেক্ষা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনের সঙ্গে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বটে।

গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছে যথাযথ ভর্তিপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করে। শিক্ষার্থীদের পছন্দক্রম অনুযায়ী ভর্তি পর পরবর্তী সময় আসনগুলোয় যে অদলবদল হয়, তার দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসেছে। অথচ এই তুচ্ছ একটি সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না, এমনকি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না।

অথচ বিষয়টি আমরা কিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করলে সমাধান করে ফেলতে পারি। আমি আগেও প্রথম আলোতে লিখেছি, আবার বলেছি। এই ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থান, শিক্ষকসংখ্যা ও সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে দুই বা তিনটি ক্যাটাগরি করা যেতে পারে। যেখানে একজন শিক্ষার্থী ভর্তির সময় তাঁর পছন্দক্রম দেবেন। স্কোর অনুযায়ী এসব শিক্ষার্থী পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হবেন। এই ক্ষেত্রে আন্তবিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিভাগগুলোয় আবার শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক স্কোর ও পছন্দ অনুযায়ী ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে।

এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় অটোমাইগ্রেশেনের প্রয়োজন পড়বে না। ভর্তিপ্রক্রিয়ার জন্য অবশ্যই একটি ভালো মানের সার্ভার ও ওয়েবসাইটের প্রয়োজন পড়বে। যেখানে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থী নিজের ভর্তি পরীক্ষার স্কোর ও কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হবেন।

অথচ অটোমাইগ্রেশনের ঝামেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির সমস্যায় পড়ছে দাবি করে ‘গুচ্ছ বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’কে জটিল ও অজনপ্রিয় করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ভর্তি পরীক্ষা থেকে আসা কিছু কাঁচা পয়সার জন্য কতিপয় ব্যক্তি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আবার ভোগান্তির ব্যবস্থা করছেন, যা কখনোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।

ধারণা করছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা অথবা সেখানে কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সুবিধার আশকারায় হয়তো এবার গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা থেকে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিটকে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী শিক্ষা মন্ত্রণালয় নখদর্পহীন বাঘ কি না, তা ভাবার সময় এসেছে।

মনে রাখতে হবে, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা ভবিষ্যতে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন বড় সোপান। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে এই কাতারে আনতে না পারার ব্যর্থতা অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাঁধে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের কাঁধেও তা পড়ে। অথচ সরকার চাইলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে জাতীয় বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন কেবল একটি ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল। ইউজিসি যদি বলে, ‘তোমরা যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না গ্রহণ করো, তাহলে তোমাদের বার্ষিক বাজেট বন্ধ অথবা ৩০ শতাংশ কম আসবে।’ তাহলে নিশ্চিত থাকেন, ভবিষ্যতে একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কেউ পিছপা হতো না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বারবার তাগাদায়ও যদি ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় এবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় না আসে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। কারণ, যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে, তাদের অধ্যাদেশের ৯(৫) বলা হয়েছে, ‘চ্যান্সেলরের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাহলে এই আইনের যা কিছুই থাকুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারবেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য থাকবে।’

বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। লাখো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসবে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]