কোভিড মহামারি চীনে শুরু হলেও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: রয়টার্স

গত বছর তাইওয়ানের বংশোদ্ভূত প্রবাদপ্রতিম ব্যবসায়ী মরিস চ্যাং ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন প্রায় মারা গেছে’। কোভিড-১৯ এবং চীন-আমেরিকার পাল্লায় বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তা দেখে অনেক বিশ্লেষকই চ্যাংয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন এবং অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের পরিধি দেশের মধ্যে এবং বড়জোর আশপাশের দেশের মধ্যে সীমিত করে ফেলেছে। তবে বিশ্বায়ন একেবারে শেষ হয়ে গেছে বলে উপসংহার টেনে দেওয়াটাও ভুল হবে।

মোটাদাগে জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক পরিসরে আবদ্ধ না থেকে দূরত্বগত দিক থেকে আন্তমহাদেশীয় পারস্পরিক নির্ভরতাপ্রসূত প্রবৃদ্ধিই হলো বিশ্বায়ন। এটি ভালোও না, খারাপও না। এর বহুবিধ মাত্রা আছে। সবচেয়ে বড় কথা এটি নতুন কিছু নয়। প্রায় ১০ লাখ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে অন্যান্য অঞ্চলে পাড়ি জমানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত মানব সম্প্রদায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটির মধ্যে আছে।

এ প্রক্রিয়া সতত জৈবিক সংসর্গ ও পরস্পরনির্ভরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্লেগের উদ্ভব হয়েছিল এশিয়ায়, কিন্তু ১৩৪৬ থেকে ১৩৫২ সালের মধ্যে এ প্লেগে ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা পড়েছিল। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে যখন ইউরোপীয়রা পশ্চিম গোলার্ধ অঞ্চলে যায়, তখন তাদের দেহের সঙ্গে এমন এক প্যাথোজিন (রোগ সংক্রমণ সংঘটক যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি) বহন করে নিয়ে যায়, যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয়।

আর সামরিক বিশ্বায়নের বয়স আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সময় থেকে শুরু। তাঁর সাম্রাজ্য তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত ছিল। অবশ্যই সেই উনিশ শতকের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা আমাদের মনে পড়ে যে সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যেত না। আবার সামাজিক–সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের আদলে বড় বড় ধর্ম এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়েছে।

এতে আরেকটি বিষয় অনুমান করা যায়, এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ নতুন বাণিজ্য মূলত চীনা বাণিজ্যের মধ্যস্থতায় হচ্ছে। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যতটা নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার চেয়ে অনেক বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন বেশ কিছু বৈশ্বিক ইস্যু আছে, যার সমাধান কোনো একক দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সে কারণে বলা যায় বিশ্বায়ন একেবারে শেষ হয়ে যাবে, তা নয়।

সর্বসাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ওপর। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বলতে খাদ্যপণ্য, পরিষেবা, পুঁজি, প্রযুক্তি ও তথ্যের আন্তমহাদেশীয় আদান–প্রদানকে বোঝানো হয়। পারস্পরিক লেনদেনজনিত বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি, যা দূরত্বজনিত খরচ কমিয়ে দিয়েছে এবং আজকের অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে ‘আরও ছিপছিপে ও আরও ক্ষিপ্র’ করেছে।

মধ্যযুগে এশিয়া ও ইউরোপকে যুক্ত করা সিল্ক রোড ছিল বটে, কিন্তু সেই আমলে আজকের দিনের মতো আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজের বহর ছিল না। এ ছাড়া ইন্টারনেট এখন চোখের পলকেই মহাদেশগুলোকে ভার্চ্যুয়ালভাবে যুক্ত করে ফেলতে পারছে।

বিংশ শতকে আধুনিক বিশ্বায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বায়ন ছিল একটি অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ। পরবর্তীকালে সেটা রাজনৈতিক চেহারায় মোড় নেয়।

আরও পড়ুন

নতুন একটি বিশ্বায়ন কি আসন্ন

১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে পারস্পরিক নির্ভরতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। খাদ্য, পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে এক দেশ আরেক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু চার বছরের ধ্বংসযজ্ঞ শেষে সেই পারস্পরিক নির্ভরতা নাটকীয়ভাবে কমে যায়। বিশ্ববাণিজ্য ও বিনিয়োগ এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল যে ১৯১৪ সালের পর্যায়ের বাণিজ্য সম্পর্কে পৌঁছাতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল।

 প্রশ্ন হচ্ছে, এখন আবার সেই অবস্থা ফিরে আসতে পারে কি না। উত্তর হলো, আসতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া অথবা চীন যদি সংঘাতে জড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে চীনের স্পর্শকাতর অনেক পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়টাতে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ২১ থেকে ১৭ শতাংশে পড়ে গেছে। তবে অন্যদিকে এই সময়টাতে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এ হিসাব আবার আমাদের এ ধারণা দেয় না যে বিশ্বায়ন মৃতবৎ।

আরও পড়ুন

বিশ্বায়ন পাল্টা আঘাত হেনেছে

এতে আরেকটি বিষয় অনুমান করা যায়, এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ নতুন বাণিজ্য মূলত চীনা বাণিজ্যের মধ্যস্থতায় হচ্ছে। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যতটা নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার চেয়ে অনেক বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

এখন বেশ কিছু বৈশ্বিক ইস্যু আছে, যার সমাধান কোনো একক দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সে কারণে বলা যায় বিশ্বায়ন একেবারে শেষ হয়ে যাবে, তা নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানবিষয়ক লেখক