ইসরায়েলের যুদ্ধ ইরানকে যেভাবে বদলে দিল

ইসরায়েলের নগ্ন আগ্রাসনে ইরানিদের মধ্যে দেশপ্রেম নতুন মাত্রা পেয়েছেছবি: এএফপি

ভঙ্গুর একটি যুদ্ধবিরতি তেহরানের আকাশে পরিচিত হয়ে ওঠা বিস্ফোরণের শব্দ আপাতত বিরতি দিয়েছে। আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৮ সালে, ইরাক-ইরান যুদ্ধ থামার এক বছর আগে। আমাদের প্রজন্মের কাছে যুদ্ধ ছিল অতীতের বিষয়। এই গ্রীষ্ম আসার আগে তা ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় একটা বিষয়।

১২ দিন ধরে, আমরা রাজধানীতে বসবাস করেছি ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন হামলার মধ্যে। আমরা যা দেখেছি, তা আমাদের চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, প্রতিবেশীদের মৃতদেহ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িঘর এবং মানুষের সীমাহীন উদ্বেগ।

‘ইরানি জনগণ’ বলার মধ্যে একধরনের স্বস্তি কাজ করে। এতে মনে হয় যেন আমরা সবাই একটি ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু অধিকাংশ সমাজের মতো, ইরানিদের মধ্যেও বিভিন্ন মতপার্থক্যের মানুষ রয়েছেন। এমন অনেক মানুষ ছিলেন, তাঁরা (অন্তত যুদ্ধের সূচনালগ্নে) এটা দেখে খুশি হয়েছিলেন তাঁদের অপছন্দের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ নেতৃত্বকে একটি বিদেশি শক্তি লক্ষ্যবস্তু করেছে।

আরও পড়ুন

আবার ভিন্নমতাবলম্বীদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ ছিলেন, যাঁরা বিদেশি শক্তির আগ্রাসনকে প্রবলভাবে ঘৃণা করেন। কিছু কট্টরপন্থী এই যুদ্ধকে দেখেছিলেন ধর্মযুদ্ধ হিসেবে। তাঁরা মনে করেছিলেন, শেষ পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। আর কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা কী ঘটছে আর না ঘটছে, সে ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি উদাসীন।

সাধারণ মানুষের হতাহতের ছবি আর ভিডিওতে যতই সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর ভরে উঠছিল এবং হামলা যতই কঠোর ও নির্বিচার হতে লাগল, ততই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ‘ওয়াতান’ বা জন্মভূমির ধারণাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করলেন। দেশপ্রেম নতুন মাত্রা পেল, বেশির ভাগ মানুষের কণ্ঠে জাতীয় গৌরবের সুর অনুরণিত হলো।

যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েলকে বিশ্বাস করা হবে বোকামি। ইসরায়েল বারবার দায়মুক্তি নিয়েই চুক্তি লঙ্ঘনের রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর মানে হলো বিস্ফোরণের শব্দ স্তিমিত হলেও তেহরানের ওপর এখনো ডেমোক্লসের তরবারি ঝুলে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে, এক কোটির বেশি মানুষের এই শহর যেন আগের মতোই ব্যস্ত জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা এখনো বাতাসে ভাসছে।

আমার বিচারে ইউরোপের দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটা ইরানে ইসরায়েলের নির্বিচার আগ্রাসন চালিয়ে যেতে মূল ভূমিকা রেখেছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মহাদেশটির নীরব থাকা অন্য দেশগুলো ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন দিয়েছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদে সহায়তা—পুরোনো সেই যুক্তি দিয়ে দেশগুলো এই হামলার ন্যায্যতা দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে আগামী দিনের ইরানের কল্পিত ছবি এঁকেছেন।

কিন্তু আমরা যারা মধ্যপ্রাচ্যে বাস করি, জানি বাস্তবতাটা কী। গাজার ধ্বংসযজ্ঞের ছবি প্রতিদিন আমাদের সামনে আসে। আমরা স্মরণ করতে থাকি লিবিয়ার বিশৃঙ্খলা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাকে দুই দশকের দখলদারত্ব এবং আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানের কথা। এসব সংঘাতে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না, গণতন্ত্রের কোনো বীজও রোপিত হয়নি।

নিশ্চয়ই ইসরায়েলের আগ্রাসনের নগ্ন বাস্তবতা তাদের কাছেও প্রতিধ্বনিত হওয়ার কথা ছিল, যারা সঠিকভাবেই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে নিন্দা করেছিল, যাতে আরেকটি যুদ্ধ আবারও এই অঞ্চলকে ধ্বংস না করে। আর নিঃসন্দেহে এই হামলাগুলো ছিল নিষ্ঠুর, উসকানিহীন ও ইচ্ছাকৃত।

আরও পড়ুন

জাতিসংঘ সনদের প্রতি এই অবজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দার বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেউই কথা বলেননি। নীরবতাটাই ছিল সবচেয়ে বড় বধিরতা। এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো ইরানিদের জীবন স্পষ্টতই অন্যদের জীবনের চেয়ে কম মূল্যবান।

আমাদের অনেকের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে খোলাখুলি সমর্থন দেওয়ার ঘটনার মূল শিক্ষা ছিল এটিই। যুদ্ধ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে, কিন্তু তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছিল সেই পুরোনো নীলনকশায়, সেটা হলো বর্ণবাদ।

অনেক ইরানি এখন পশ্চিমাদের এই অন্যায্যতার প্রতি ক্ষুব্ধ। এতটাই ক্ষুব্ধ যে তাঁরা এখন চান, ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। অথচ এই ধারণা এত দিন পর্যন্ত কট্টরপন্থী রাজনৈতিক মহলে সীমাবদ্ধ ছিল। এটা এখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে। যেমন একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কেউই মনে হয় উদ্বিগ্ন নন।’ তিনি ইঙ্গিত করেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাধা।

আরও পড়ুন

যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েলকে বিশ্বাস করা হবে বোকামি। ইসরায়েল বারবার দায়মুক্তি নিয়েই চুক্তি লঙ্ঘনের রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর মানে হলো বিস্ফোরণের শব্দ স্তিমিত হলেও তেহরানের ওপর এখনো ডেমোক্লসের তরবারি ঝুলে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে, এক কোটির বেশি মানুষের এই শহর যেন আগের মতোই ব্যস্ত জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা এখনো বাতাসে ভাসছে।

যে বিষয় পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে, তা হলো যুদ্ধ শেষ করার মতো কোনো বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী এখানে নেই।

  • হোসেইন হামদিয়েহ বার্লিনের হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিংস কলেজ লন্ডন থেকে ভূগোল ও নৃতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন

    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত