এখন কৈশোর যার, জানতে হবে তার

১৪ বছর বয়সী আদিব (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ভীষণ প্রাণবন্ত আর স্বভাবে উচ্ছল ছেলেটি একদিন স্কুল ও কোচিং শেষে বাসায় ফিরে একদম চুপচাপ। কিছু খায়নি, পড়াশোনায়ও মন নেই। সন্ধ্যায় মা অফিস থেকে ফেরার পর ছেলের চেহারা দেখেই বুঝে যান, ছেলের কিছু একটা হয়েছে। রাতে ছেলের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানতে পারেন, আদিব তার বন্ধুদের কিছু আচরণে মুষড়ে পড়েছে। আদিবের মুঠোফোনের স্ক্রিনসেভার হিসেবে ছিল মায়ের সঙ্গে তোলা তার পছন্দের একটি ছবি। বন্ধুরা বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করেছে, তাকে ‘মম্মাস বয়’, ‘বেবি বয়’—এসব বলেছে। শুধু তা–ই নয়, তারা তার মায়ের চেহারা, শারীরিক গঠন ইত্যাদি নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেছে; যা কিছুতেই মানতে পারছে না আদিব। তীব্র ভাষায় বন্ধুদের টিটকারির প্রতিবাদ জানিয়েছে আদিব। কিন্তু মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। মায়ের সঙ্গে কষ্টের অনুভূতি শেয়ার করার একপর্যায়ে কাঁদতে শুরু করে আদিব।

আনিলা (ছদ্মনাম) ঢাকার অন্যতম সেরা একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের ক্লাসের প্রায় সবারই বন্ধুত্বের বাইরে নতুন নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগেরই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে একই ক্লাসে পড়া বন্ধুদের সঙ্গে। সবাই নাকি বাইরে ঘুরতে যায়, যেটিকে নাকি ডেট বলে। এখন সে সম্পর্কে তেমন কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই আনিলার। তবে বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য ভয়মিশ্রিত একধরনের কৌতূহল আছে তার। আনিলা বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছে, প্রেম করতে বন্ধুর সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যেতে হবে কথা নেই। চ্যাট বক্সে ভার্চ্যুয়ালিও নাকি দিব্যি প্রেম করা যায়। আনিলার এখনো এমন কোনো বন্ধু না থাকায় রীতিমতো বিড়ম্বনায় পড়েছে সে। ক্লাসের অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। শুধু তা–ই নয়, ক্লাসের ফাঁকে কিংবা টিফিনের বিরতিতে বন্ধুরা সবাই যখন নিজেদের জুটিতে ব্যস্ত থাকে, তখন আনিলার ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে।

আমরা কৈশোরের প্রতিটি কৌতূহলকে, প্রতিটি প্রশ্নকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শিখি এবং তাদের প্রতি বাড়িয়ে দিই সহযোগিতার হাত। উজ্জ্বল কৈশোরের পথ বেয়ে আসুক আলোকিত যৌবন

একই ক্লাসে পড়া জিশান (ছদ্মনাম) আর রাত্রির (ছদ্মনাম) মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এক মাস আগে। তারা দুজনই চট্টগ্রামের একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রাত্রির ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পর্ক প্রথম হলেও জিশানের এর আগেও একটি প্রেমের সম্পর্ক ছিল; যার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দুই মাস। সুযোগ পেলেই জিশানের হাত ছুঁয়ে যায় রাত্রির শরীরের স্পর্শকাতর স্থান। বিষয়টি লক্ষ করেছে তাদের ক্লাসেরই আরেক শিক্ষার্থী মাসরুর (ছদ্মনাম)। জিশানের স্পর্শে রাত্রির মধ্যে অস্বস্তির বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে মাসরুর একদিন সাহস করে রাত্রির কাছে জানতে চায়, সে তার ভালো না লাগার বিষয়টি জিশানকে জানায় না কেন! উত্তরে রাত্রি বলে, ‘প্রেমের সম্পর্কে এমন স্পর্শ স্বাভাবিক বলে শুনেছি। ভালো না লাগার বিষয়টি হয়তো আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। এই সমস্যার কথা অন্যদের জানালে তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে।’ তাই সে মাসরুরকে বিষয়টি গোপন রাখতে বলে।

আদিব, আনিলা, মাসরুর, রাত্রি নামগুলো ছদ্মনাম হলেও প্রতিটি ঘটনা কিন্তু সত্য। এসব চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করছে সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারের বয়ঃসন্ধিকালীন সন্তানদের। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েদের অবস্থাও যে খুব একটা আলাদা, তা কিন্তু নয়। কোভিডের বন্দী দিনগুলোর ভেতর শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা ছেলেমেয়েগুলো কোভিডমুক্ত নতুন পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পর্কের রহস্যভেদে যেন অনেকটাই দিশাহারা ও টালমাটাল হয়ে পড়েছে।

এ দেশে কিশোর বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। বয়ঃসন্ধিকালীন সময়টি এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর কোভিডকালের জনবিচ্ছিন্নতা ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতা শিশু-কিশোরদের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। 

কোভিডের দিনগুলোয় শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন গ্যাজেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এসব গ্যাজেটের অপরিণত ব্যবহারের ফলে সম্পর্কের নতুন নতুন সংজ্ঞা ও পরিধি নির্ধারিত হয়েছে। এখন স্বাভাবিক সময় ফিরে এলেও প্রযুক্তির সেই মোহ থেকে তাদের দূরে সরানো যাচ্ছে না। ফলে সম্পর্কগুলোও স্বাভাবিকতা পাচ্ছে না। বন্ধু কিংবা সহপাঠীকে নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে একজন মানুষ কিংবা শুধু বন্ধু ভাবার মানসিকতা থেকে যেন সরে এসেছে তারা।

বয়ঃসন্ধিকালে ভিন্ন লিঙ্গ ও যৌনতা নিয়ে কিশোরদের মধ্যে সীমাহীন কৌতূহল থাকলেও তাদের নানা প্রশ্ন মোকাবিলায় পারিবারিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নেই তেমন কোনো আয়োজন। নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে শিশু-কিশোরদের অজ্ঞতা এবং মাত্রাহীন কৌতূহল জন্ম দিতে পারে যেকোনো দুর্ঘটনা। কিশোর বয়সী অনেক ছেলেমেয়েই পর্নোগ্রাফিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, অপ্রত্যাশিত সম্পর্কে জড়াচ্ছে, হতাশায় ভুগছে, এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। গত বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর একটি সুপরিচিত ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের মেয়েশিক্ষার্থীর বন্ধুর বাড়িতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো এ ধরনের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অশনিসংকেত দেয় আমাদের।

বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য পরিবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে ঐকান্তিকতা, মানসিক দৃঢ়তা ও প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন, ঘাটতি মূলত সেখানেই। এসব বিষয় আর দশটি বিষয়ের মতো নয়। বিষয়গুলো নিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। এ ক্ষেত্রে শিশুর শিক্ষার ভিত্তিভূমি হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান—পরিবার ও স্কুলকে একযোগে তৈরি করতে হবে। দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন বিশ্বাস ও চর্চা বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুর মূল্যবোধ গঠনের প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করে; যার প্রভাব পড়ে সম্পর্কের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে আর সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তুলতে। সামনে আসছে নতুন শিক্ষাক্রম। জানি না এসব বিষয়কে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে। কৈশোরের যেকোনো কৌতূহলী প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা জন্ম দিতে পারে একটি স্খলিত মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম। তাই আসুন, আমরা কৈশোরের প্রতিটি কৌতূহলকে, প্রতিটি প্রশ্নকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শিখি এবং তাদের প্রতি বাড়িয়ে দিই সহযোগিতার হাত। উজ্জ্বল কৈশোরের পথ বেয়ে আসুক আলোকিত যৌবন।

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

[email protected]