ট্রাম্প যে কারণে ধনকুবেরদের কাছে বোকাই থেকে যাবেন

নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সন্ধ্যাগুলোর একটি নির্দিষ্ট রুটিন ছিল। ওই সময়টাতে তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বড় একটি চিজ বার্গার এবং একটি বালতি সাইজের ডায়েট কোক নিয়ে বিছানায় বসতেন। তাঁর সামনে অনেকগুলো টিভি চলত। যে টিভিতে তাঁকে নিয়ে আলোচনা চলত, শুধু সেই চ্যানেলগুলো তিনি দেখতেন।

টিভি দেখতে দেখতে ট্রাম্প শতকোটিপতিদের সঙ্গে ফোনে আলাপ করতে ভালোবাসতেন। সেই ফোনালাপে তিনি তৃতীয় কারও নামে কুৎসা গাইতেন, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন এবং এমন অনেক গোপন কথা বলে দিতেন, যা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর বলার কথা নয়।

ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ শেষ করে অপর প্রান্তের সেই শতকোটিপতি ভদ্রলোক হয়তো অন্য কোনো শতকোটিপতির কাছে ফোন করতেন এবং ট্রাম্পের কথাবার্তা নিয়ে তাঁরা হাসাহাসি করতেন।

একবার মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ শেষে ট্রাম্প সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘কী ধরনের বেকুব লোক একটা!’ ওই ফোনালাপে মারডক ট্রাম্পকে বুঝিয়েছিলেন, সিলিকন ভ্যালির ধনকুবেরেরা আসলে তাঁর (ট্রাম্পের) সাহায্যের ধার ধারেন না; কারণ প্রায় আট বছর ধরে ওবামা প্রশাসনকে কার্যত তাঁরাই চালিয়ে এসেছিলেন।

মারডক এমনিতে একজন বদমেজাজি ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মিন গার্লস সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রেজিনা জর্জ’ (যিনি ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতে চান)-এর সঙ্গে মারডকের তুলনা করা চলে। তবে মারডক ট্রাম্পের ‘ক্লিয়ার্ড কলার’-এর তালিকায় ছিলেন। অর্থাৎ তিনি চাইলেই যেকোনো সময় ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।

ট্রাম্প-সমর্থক ধনকুবেরদের ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা নিয়ে আমি বিশদ গবেষণা করে দেখেছি। এ সময় আমার সাকসেশন সিরিজের সেই টেক বিলিয়নিয়ারের কথাটিকে প্রণিধানযোগ্য মনে হয়েছে।

যেহেতু নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে, সেহেতু এসব ধনকুবেরকে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে এসব ধনকুবেরের গসিপ বা গালগল্প করার আগ্রহ বেশি দিন থাকবে কি না, তা নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে।

ওই বিলিয়নিয়ার আমেরিকার ক্ষমতার বলয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পূর্ব একটি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ওই ধনকুবের চরিত্রটির ভাষায়, ‘আমি ভেবেছিলাম এই ক্ষমতাধর রাজনীতিকেরা জটিল প্রকৃতির হবে, কিন্তু তাঁরা আসলে তা নন। তাঁদের ওখানে শুধু টাকাপয়সার লেনদেন আর গল্পগুজব হয়।’

কমলা হ্যারিসকে সমর্থনকারী ধনকুবেরদের সংখ্যা বাড়ছে। এটি সংবাদমাধ্যমে তাঁর জন্য একটি অর্জন হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু কমলার প্রতি ধনকুবেরদের সমর্থন বাড়ার খবর ট্রাম্পের পক্ষ নেওয়া বিশেষ ধনিকশ্রেণির কাছে ট্রাম্পের পেছনে আরও বিশাল পরিমাণ অর্থ ঢালা এবং ট্রাম্পের সঙ্গে আরও গল্পগুজব করার প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

এই মোগল শ্রেণি মনে করে, অর্থ অর্জনের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ও তার মাধ্যমে কর হ্রাস করা। আর ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোসের মতো ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আরও লাভজনক হলো সরকারের বড় বড় ঠিকাদারির কাজ পাওয়া।

শো বিজে গসিপ বা গল্পগুজবকে সাধারণত হালকা ও ঠুনকো মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ‘মোগল’ শ্রেণির মাঝে গসিপের ব্যাপকতা অনেক বেশি। অর্থ সুখ কিনতে পারে না ঠিকই, তবে এটি এমন উন্নতমানের অর্থকরী গসিপের পথ তৈরি করে দেয়, যেখানে মারডক, বেজোস, স্টিভ উইন, স্টিফেন শোয়ার্জম্যানসহ অন্য মোগলরা প্রায় ‘অস্ত্রসজ্জিত পর্যায়ের’ গসিপ চালান।

এই ক্ষমতাশালীদের মধ্যে গসিপ ও শক্তির খেলা অনেকটাই নিষ্ঠুর ও কৌশলপূর্ণ। এটি তাঁদের মধ্যে একধরনের ‘হাই-কোয়ালিটি গসিপ’ বা প্রভাবশালী তথ্যবিনিময়ের সংস্কৃতি তৈরি করে।

এই গসিপ ও অর্থের চক্রের কাছে ট্রাম্প এমন একজন ‘দরকারি বোকা’ হিসেবেই রয়ে গেছেন, যাঁর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া যায়। এ কারণে মারডকের কাছে তিনি ‘চরম বোকাই’ রয়ে গেছেন। তাঁকে যাতে ব্যবহার করা যায়, সে জন্য তাঁরা ট্রাম্পের যতই সমালোচনা করুন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে ট্রাম্পের গসিপ বা খোশগল্প চলতেই থাকবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুখ্যাত বিনিয়োগকারী পেল্টজ তিন বছর আগে বলেছিলেন, ৬ জানুয়ারির বিদ্রোহের জন্য ট্রাম্পকে চিরদিন কলঙ্ক বহন করে যেতে হবে। তিনি সে সময় ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু কিছু বছর পরই দেখা যায়, সেই পেল্টজই আবার ট্রাম্পের জন্য তাঁর বাড়িতে অর্থ সংগ্রহের আয়োজন করেছেন। এতে বোঝা যায়, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পেল্টজ নিজের অবস্থান বদলাতে দ্বিধা করেন না।

পেল্টজের মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাজনের ওপর একটি অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত চালানোর জন্য ট্রাম্পকে প্রভাবিত করা, কারণ আমাজন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল বলে তিনি মনে করছিলেন।

যদিও ট্রাম্প আমাজনের বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্ত শুরু করেননি, তবে আমাজনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু টুইট করেছিলেন।

এমন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্কগুলো অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।

পেল্টজের এই দ্বৈত মনোভাব আসলে এক বৃহত্তর চিত্রের অংশ। এখানে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজ নিজ অবস্থান পরিবর্তন করতে দ্বিধা করেন না। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কখনো সমালোচনা হালকা হয়ে যায়, আবার কখনো নতুন মিত্র তৈরি হয়।

 এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন ইলন মাস্ক। তিনি প্রথম থেকেই ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ইলন মাস্কের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হবে, যেটি তাঁর প্রতিষ্ঠানকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।

যেহেতু নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে, সেহেতু এসব ধনকুবেরকে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে এসব ধনকুবেরের গসিপ বা গালগল্প করার আগ্রহ বেশি দিন থাকবে কি না, তা নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে।

  • মারিনা হাইড দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক

  • দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত