কেমব্রিজ যে কারণে অনন্যসাধারণ

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ছবি : রয়টার্স

১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সূচনালগ্ন থেকেই সমগ্র বিশ্বে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেছে। নিউটন, ডারউইন থেকে শুরু করে ডিরাক, হকিং প্রমুখ প্রতিভাসমূহ জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কালজয়ী অবদান রেখেছেন। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরি এমন একটি কারখানা, যেখান থেকে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার উৎপন্ন হয়েছে। আইনস্টাইনকে যখন বলা হয়েছিল নিউটনের কাঁধে ভর করে তিনি এত দূর অগ্রসর হয়েছেন, আইনস্টাইন উত্তরে বলেছিলেন, নিউটন নয়, ম্যাক্সওয়েল।

ম্যাক্সওয়েল ক্যাভেন্ডিসের অধ্যাপক ছিলেন। ম্যাক্সওয়েল ছাড়াও আরও অনেক দিকপাল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ইলেকট্রন, নিউট্রন এখানেই আবিষ্কৃত হয়। বলা যেতে পারে পরমাণুর গঠন-সম্পর্কিত আধুনিক ধারণার জন্ম এখানেই। ডিএনএর ডাবল হেলিক্স গঠনও এখান থেকেই আসে। এ পর্যন্ত (২০১৯) ক্যাভেন্ডিস থেকে ৩০ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সবার প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান রেখে মাত্র কয়েকজনের নামোল্লেখ করছি—রাদারফোর্ড, থমসন, চ্যাডউইক, উইলসন, ব্রাগ, ক্রিক প্রমুখ। যাঁর নামে ল্যাবরেটরি, তিনি একাধারে পদার্থ ও রসায়নবিদ ছিলেন। শুরুতে বিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যার এখানেই চর্চা হতো। পরে পদার্থ ছাড়া অন্য বিষয়গুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।

শুধু প্রত্যক্ষভাবেই নয়, পরোক্ষভাবেও কেমব্রিজ তার ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। এই অগণিত ছাত্রছাত্রীর অবদানের মূল্যায়ন এখানে সম্ভব নয়। আমাদের এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অতিপরিচিত কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আবদুস সালাম কেমব্রিজের ছাত্র ছিলেন। তেমনিভাবে ভারতীয় নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনও।

উপমহাদেশের সুবিখ্যাত রাজনীতিবিদ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কেমব্রিজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও তা-ই। পৃথিবীর সফলতম রাজনীতিবিদদের অন্যতম সিঙ্গাপুরের লি খুয়ান ইউ কেমব্রিজের ট্রাইপজ ছিলেন। বাংলাদেশেও কেমব্রিজ থেকে লেখাপড়া করা অনেকে আছেন যেমন জামাল নজরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও স্থানের স্বল্পতার কারণে অনেকের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে দুঃখিত।  

এহেন কেমব্রিজে এই অধমের পিএইচডি করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখনো অনেকটা অপরিচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। সৌভাগ্যের কারণটি বোধ হয় এই যে আমি একটা ভালো স্কলারশিপ পেয়েছিলাম; একই স্কলারশিপে বহু বছর আগে নিউজিল্যান্ড থেকে রাদারফোর্ড ব্রিটেনে এসেছিলেন। (কার সঙ্গে কার তুলনা!)। আমার সময়ে কেমব্রিজে নোবেল লরিয়েটের ছড়াছড়ি ছিল। ১৯৬৫ সালে আমি যখন ভর্তির জন্য পত্রালাপ শুরু করি, ভৌত রসায়নের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন প্রফেসর নরিস। নরিস ওই বছরে নোবেল পুরস্কার পান। একই ভবনে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী বিভাগ রসায়নের প্রধান ছিলেন লর্ড টড, যিনি অনেক আগে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত এবং বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লর্ড খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে নরিসের সংবর্ধনায় লর্ড টড প্রধান বক্তা ছিলেন।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে লেখাপড়া করতে হলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোনো একটি কলেজে ভর্তি হতে হয়। কলেজীয় পদ্ধতি এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ কলেজগুলো কিন্তু আমাদের দেশের কলেজের মতো নয়। এমনকি ব্রিটেনের ইমপিরিয়াল কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের মতো নয়। এ রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য ধরে নিয়ে বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং করা হয়। অক্সব্রিজের কলেজগুলো অনেকটা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর মতো, শুধু আরেকটু বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।

আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সব্রিজের আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ক্লাস ও ল্যাবরেটরি ব্যতিরেকে কলেজগুলোতে অন্য সব রকমের সুযোগ-সুবিধা আছে। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত ছাড়াও লাইব্রেরি, অডিটরিয়াম ও ফুটবল, ক্রিকেট থেকে শুরু করে প্রায় সব রকম খেলার সুবন্দোবস্ত আছে। ছাত্রছাত্রীরা নিজস্ব রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লাব বা সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি খেলার জন্য আলাদা আলাদা ক্লাব আছে যেমন ফুটবল ক্লাব, ক্রিকেট ক্লাব, নৌকা বাওয়া ক্লাব ইত্যাদি।

এমনিভাবে আলোকচিত্র সমিতি, সংগীত সমিতি, সক্রেটিক সমিতি প্রভৃতি আছে। কলেজগুলো স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলেজের দৈনন্দিন কাজকর্ম দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেন। কলেজগুলোর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ফেলোশিপ পদ্ধতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সাধারণত ফেলো নির্বাচিত হন। কখনো কখনো বাইরের নামকরা লোকদেরও ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। যে কলেজে যত বেশি বিখ্যাত লোকের সমাহার, সে কলেজ তত মর্যাদাপূর্ণ।

কলেজের প্রধান পদটির নাম মাস্টার—একটি অতি সম্মানজনক পদ। আমি যত দূর জানি কলেজ কর্তৃপক্ষই মাস্টার নির্বাচন করে, আমাদের দেশের মতো উপাচার্য নন। আমার চার্চিল কলেজের মাস্টার ছিলেন নোবেল লরিয়েট স্যার জন ককরফ্ট। ওই সময়ে ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার ছিলেন সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বাটলার। কয়েক বছর আগে অমর্ত্য সেন পদটি অলংকৃত করেছিলেন। ডিএনএ গঠনের আবিষ্কারক ফ্রান্সিস ক্রিক চার্চিল কলেজের ফেলো ছিলেন।

অক্সব্রিজ পদ্ধতিতে কলেজের ডাইনিং হলের গুরুত্ব অনেক। ডিনারে যদিও গাউন পরে মাস্টারের নেতৃত্বে ফেলোগণ হাই টেবিলে এবং ছাত্রছাত্রীরা সাধারণ টেবিলে বসেন, অন্য সময়ে ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চে ফেলো এবং ছাত্রছাত্রীরা সাধারণ টেবিলে বসেন। খাবারদাবার ভর্তুকিপ্রাপ্ত হওয়ায় অনেকে খেতে আসেন। ফলে নিজেদের মধ্যে এবং ফেলোদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে আগে ধার্যকৃত সময় ছাড়া সাধারণত কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না। তাই এটি একটি বড় সুযোগ। ফেলোগণও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আনন্দিত হয়ে মেশেন এবং সম্পর্ক সহজ করে তোলেন।

একদিন গবেষণা বিষয়ে আলোচনার সময় আমার সুপারভাইজার বললেন, লাঞ্চের সময় হয়তো ক্যাম্পবেলের সঙ্গে দেখা হবে, আমি আলাপ করব। ক্যাম্পবেল পিএইচডির ছাত্র, মোটামুটি আমার কাছাকাছি বিষয়ে গবেষণা করছে, আর আমার সুপারভাইজার একজন বিখ্যাত প্রফেসর। কলেজে মাঝেমধ্যে আনুষ্ঠানিক ডিনার হতো এবং সেখানে ফেলোদেরকে ছাত্রদের মধ্যে বসার ব্যবস্থা করা হতো, যাতে ছাত্ররা ফেলোদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। একদিন লাঞ্চ খাচ্ছি এবং একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছি। ছেলেটি বলল, ওই যে ভদ্রলোককে দেখছ, তাঁর নাম হিউইস, পালসার (pulsating star) আবিষ্কার করেছেন, হয়তো বা নোবেল পুরস্কার পাবেন। পরবর্তীকালে সেটাই ঘটেছিল।

বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর দায়িত্ব, বাকি সবকিছু কলেজের। প্রত্যেক ছাত্রের জন্য কলেজে টিউটর আছেন, যাঁর দায়িত্ব হচ্ছে ছাত্রের শারীরিক, মানসিক, একাডেমিক এমনকি ব্যক্তিগত ব্যাপারেও উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া। ছাত্রের কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে তার জন্য সুপারভিশনের ব্যবস্থা করা হয়। অক্সফোর্ডে এটাকে টিউটোরিয়াল বলা হয়। এই পদ্ধতির কারণে প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের একটি গ্রহণযোগ্য মানের দখল থাকে। অন্যদিকে কলেজের পরিবেশ তাদের শরীর, মন, চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদির ওপর প্রভূত প্রভাব ফেলে এবং আত্মবিশ্বাসী অনন্য ব্যক্তিত্ব রূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

কেমব্রিজের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এখানকার লেকচারগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ যেকোনো ক্লাসে যোগদান করতে পারে। এ সুযোগ আমি কাজে লাগিয়েছিলাম। অনেকের লেকচারে গিয়েছি, কোনোটা অনেক উঁচু স্তরের, কোনোটা অতটা নয়, কিছু বুঝেছি কিছু বুঝিনি। সৌভাগ্যক্রমে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেওয়া লাগেনি। পরীক্ষা দিতে হলে নির্ঘাত ফেল করতাম। সবচেয়ে বিখ্যাত যে বিজ্ঞানীর লেকচারে গিয়েছি, তিনি হচ্ছেন পি এ এম ডিরাক। পল ডিরাকের জন্ম ১৯০২ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি করার পর বেকারত্বের কারণে দুই বছর ফলিত গণিত অধ্যয়ন করেন। অতঃপর কেমব্রিজে ভর্তি হন পিএইচডি করার জন্য। মাত্র ২৪ বছর বয়সে ১৯২৬ সালে তিনি পিএইচডি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তাঁর বিখ্যাত পেপার ‘The relativistic wave equation for the electron’ প্রকাশিত হয়।

শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ সমাধান করলে তিনটি কোয়ান্টাম নম্বর পাওয়া যায়, কিন্তু পরমাণুর বর্ণালি বিশ্লেষণ করতে চতুর্থ কোয়ান্টাম নম্বরের (স্পিন কোয়ান্টাম নম্বর) প্রয়োজন হয়। ডিরাকের সমীকরণ থেকে  স্পিন কোয়ান্টাম নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী এখান থেকে পাওয়া যায়। সেটি হলো ইলেকট্রনের ভরের সমান ধনাত্মক চার্জ-বিশিষ্ট একটি কণার (antimatter) অস্তিত্ব। ১৯৩২ সালে পজিট্রন নামে কণাটি আবিষ্কৃত হওয়া। এর ফলে ১৯৩৩ সালে ডিরাক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এ পর্যন্ত ৩১ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা মাত্র তিনজন, একজন ২৫ বছর বয়সী আছেন। কনিষ্ঠতম নোবেল লরিয়েট (শান্তিতে) অবশ্য পাকিস্তানি মালালা ইউসুফজাই (১৭)।

১৯৩২ সালে ডিরাক লুকেসিয়ান প্রফেসর নিযুক্ত হন, যে চেয়ারে একসময় স্বয়ং নিউটন অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নাকি স্বল্পভাষী অন্তর্মুখী ছিলেন, খুব কম লোকজনের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিল, তাঁর মেয়ে বলেছে বাবাকে কখনো হাসতে দেখেনি। চিন্তায় নিমগ্ন ডিরাককে আমি কেমব্রিজের গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে দেখেছি। ডিরাককে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০ জন পদার্থবিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। ডিরাকের তত্ত্বে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী ছিল।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যেমন পৃথকভাবে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ-বিশিষ্ট মৌলিক কণিকা (পজিট্রন ও ইলেকট্রন) পাওয়া যায়, চুম্বকের বেলায় তেমনটি ঘটে না। চুম্বককে যতই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত করা হোক না কেন, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু উভয়েই উপস্থিত থাকে। ডিরাকের তত্ত্বানুযায়ী এক মেরুবিশিষ্ট চৌম্বক কণিকা পাওয়ার কথা। এত দিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়েছে। অতি সম্প্রতি এরূপ কণিকার অস্তিত্বের আভাস পাওয়া গেছে। এটি সুনিশ্চিত হলে আমার ধারণা ডিরাকের অবস্থান আরও উন্নত হবে এবং সম্ভবত আইনস্টাইনের পরপরই তিনি থাকবেন।

কোনো বিষয়ের জন্মদাতাদের একজনের কাছ থেকে সেই বিষয়ে কোর্স নেওয়ার সুযোগ পাওয়া নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিবছরে একটি বিশেষ টার্মে ডিরাক কোয়ান্টাম মেকানিকসের ওপর একটি কোর্স দিতেন। আমি দুই টার্মে তাঁর লেকচারগুলোতে গিয়েছি। আমাদের দেশে যাঁরা নামকরা শিক্ষক, তাঁরা সাধারণত কতটা পড়াচ্ছেন, তার চেয়ে কেমন করে পড়ালে ছাত্রছাত্রীরা উপভোগ করবে, সেটার ওপরে বেশি জোর দেন। বিদেশে ব্যাপারটা উল্টো। প্রতিটি লেকচার বিষয়বস্তুতে ঠাসা থাকে। ফলে প্রতিটি লেকচার অতি মনোনিবেশ সহকারে নিয়মিতভাবে অনুধাবনের চেষ্টা না করলে পরের দিকে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। শিক্ষক হিসেবে ডিরাকের মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, তাঁর লেকচারগুলো আমি মোটামুটি বুঝতে পারতাম। Principles of Quantum Mechanics নামে ডিরাকের একটি বই আছে। এ বই অনুযায়ী তিনি লেকচারগুলো সাজাতেন।

এত দিন আগের কথা বেশি কিছু মনে নেই, শুধু দুটি বিষয় অন্তরে গেঁথে আছে। একটি হলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এ নীতি অনুযায়ী কোনো কণার ভরবেগ ও অবস্থান একই সময়ে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আধুনিক পদার্থবিদ্যায় বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা গাণিতিকভাবে অতি সহজে চলে আসে, কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতার আলোকে মানসপটে তার ছবি আঁকা খুব কঠিন হয়।

আইনস্টাইন স্বয়ং এই নীতি পছন্দ করতেন না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, God does not play dice with the universe এই নীতিকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হয়। কোয়ান্টাম মেকানিকসে অপারেটরদের কমিউটেসন (commutation) নিয়ম অনুযায়ী দুটি অপারেটর যদি কমিউট করে, তাদের সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষণীয় ধর্ম দুটি নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব। সহজ ভাষায় বলতে গেলে দুটি কার্য আগপিছু করলে ফলাফলের যদি পরিবর্তন না হয়, তাকে বলে কমিউট করা।

প্রকৃতির বিধানে অবস্থান ও ভরবেগের অপারেটরদ্বয় কমিউট করে না। অনিশ্চয়তা নীতি ব্যাখ্যার সময় ডিরাক বলছিলেন যে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি কণার অবস্থান-চ্যুতি ঘটায়। তোমরা হয়তো বলবে, আমরা কোনো যন্ত্র ব্যবহার না করে খালি চোখে দেখব, কিন্তু দেখতে হলে তো এর ওপর আলো ফেলতে হবে এবং এ আলোই কণাকে বিশৃঙ্খল করার জন্য যথেষ্ট। এ কথা আমাদের মাথায় আসেনি।

দ্বিতীয় যে জিনিস আমার মনে রেখাপাত করেছিল, সেটি হচ্ছে তাঁর বিখ্যাত রিলেটিভিস্টিক তরঙ্গ সমীকরণের প্রতিপাদন। ডিরাকের যুক্তির মূল ভিত্তি ছিল প্রতিসাম্য (symmetry)। পজিট্রনের অস্তিত্বের ক্ষেত্রেও তা-ই। আমি নিজে পদার্থবিদ্যাবিশারদ নই। তবে আমার ধারণা মৌলিক-কণিকা পদার্থবিদ্যায় প্রতিসাম্যের প্রভাব অসামান্য।

কেমব্রিজে লেখাপড়ার পরিবেশ অসাধারণ। একটি উদাহরণ দিই। আমার অতি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক (আমার মেন্টর) প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী (যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ছিলেন, ফলিত রসায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই টার্ম উপাচার্য ছিলেন) ১৯৭২ সালে Commonwealth Academic Staff Fellowship নিয়ে কেমব্রিজে গমন করেন। স্যারের বিদেশ যাওয়ার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। অনেক দিন ধরে তিনি মূত্রাশয়ের পাথরে ভুগছিলেন; অপারেশনটি বিলাতে করাতে চেয়েছিলেন। চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য ছিল, গবেষণা ততটা নয়। মাস দুয়েক পরে একটি চিঠিতে লিখলেন শেষ পর্যন্ত গবেষণায় হাত দিলাম, যেখানে সবাই কাজ করে সেখানে কেমন করে একা একা বসে থাকা যায়! ঘন ঘোর বরিষায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়ার উদ্দেশে বলেছেন,
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার—
জগতে কেহ যেন নাহি আর।  
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
মনে হতো যেন কেমব্রিজের ছাত্র-শিক্ষকেরা জ্ঞানের দেবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে সর্বতোভাবে জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত হয়েছেন, জগতের আর সবকিছু মিছে হয়ে গেছে।

  • এম লুৎফর রহমান
    অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়