বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীন গরিব মানুষ কেমন আছে  

বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণ বর্তমান খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির কারণে বাধ্য হয়ে শুধু খাদ্য গ্রহণ কমিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, মাছ-মাংস-ডিম-দুধ ইত্যাদি প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে শুধু ভাত বা আটাজাতীয় শর্করা দিয়ে পেট ভরাতে বাধ্য হচ্ছেন। সবচেয়ে দরিদ্ররা হয়তো পেট ভরে ভাতটুকু খেতে পারছেন না।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে শিল্পশ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে একটি আলোচনা সভায় এই বাস্তবতা উঠে এসেছে। এই সেমিনারে বক্তা ছিলেন বিআইডিএসের বর্তমান ডিজি বিনায়ক সেন। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মইনুল হোসেন।

সভায় বিআইডিএসের ২০২৩-২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত ৬৪টি জেলার ৬৪টি গ্রামের ৩ হাজার ৮৮৭ পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপলব্ধ তথ্যাবলি তুলে ধরা হয়। এসব তথ্য উপরিউক্ত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে দেখিয়েছে।

বাড়ছে দারিদ্র্য

সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রের বদৌলতে আমরা এটাও জেনেছি যে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক বাংলাদেশে রয়েছেন, যাঁরা দুদিন কাজ বা আয় করতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধ্য হবেন। এমনিতেই আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা করোনাকালে বেড়ে হয়েছিল ৪০ শতাংশ। পরে বিগত সরকার দাবি করেছিল, তা করোনার পর কমে ১৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শহরের শ্রমিক ও গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষদের নির্ধারিত বা উপার্জিত প্রকৃত আয় কমে গেছে। যে টাকা তাঁরা হাতে পান, তাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে পেট ভরে খাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে।

বিশেষ করে শহরের শ্রমিকদের জন্য গৃহের খরচ, যাতায়াতের খরচ, জ্বালানি খরচ ইত্যাদি এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে এসবের পর হাতে যা যৎসামান্য থাকে, তা দিয়ে তাঁদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ৩ হাজার ক্যালরির সমান পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।

নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছেন এ রকম ২ কোটি লোককে হিসাবে ধরলে আমাদের জাতীয় দারিদ্র্যের হার পুনরায় ৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নীতিনির্ধারকদের এটা নিয়ে মোটেও মাথাব্যথা নেই। তাই জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে।

বিআইডিএসের জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ২০২৩ সালের একই সময় মোট ১১ ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে এখনো গত মূল্যস্ফীতির হার ১০-১২ শতাংশ দাবি করা হয়।

সম্প্রতি মূল্যস্ফীতিকে প্রধান উপদেষ্টা এক নম্বর সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন। তবু বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অপারগ হয়েছে। ফলে আমদানি-ঘাটতি, চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগীদের ও সিন্ডিকেটের দাপট এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি।

এখন অনেক শিক্ষিত নিম্নবিত্ত এসে সেখানে যোগ হচ্ছেন। তাঁদের নতুন বাংলা নাম হচ্ছে ‘নিরাপত্তাহীন সর্বহারা’ বা ‘অনিশ্চিত ভাসমান শ্রমজীবী’। বাংলাদেশের উৎপাদনশীল আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক সর্বহারা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ‘নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত শ্রমজীবীর’ মিলিত বাহিনীটি এখন অতি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শতাংশে পরিণত হয়েছে। একার্থে তাঁরা কেউই কোনো না কোনোভাবে দারিদ্র্যের হুমকি থেকে মুক্ত নয়।

‘মন্দাস্ফীতি’তে যা করা দরকার ছিল

বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। আসল জায়গায় হাত না দিয়ে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী বর্তমান সরকার সুদের হার বাড়িয়ে, চাহিদা ও ঋণ সংকুচিত করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু উন্নত দেশের জন্য এটা অধিক কার্যকরী হলেও এ দেশে তা কার্যকরী হচ্ছে না। যেহেতু এ দেশে এখনো মন্দা চলছে, তাই যদি চাহিদা ও ঋণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে কমে আসে তাহলে মন্দা আরও গভীর হবে।

ব্যাংক যদি উৎপাদনশীল খাতগুলোতে যথাযথ মাত্রায় চলতি মূলধন সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও সরবরাহ ব্যাহত হবে। তাতে মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশে একই সঙ্গে মন্দা বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। এই জটিল পরিস্থিতিকে অর্থনীতিবিদেরা নাম দিয়েছেন—মন্দাস্ফীতি ( স্ট্যাগফ্ল্যাশন) বলে। মন্দাস্ফীতি কমাতে হলে একই সঙ্গে সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে, সরবরাহ খরচ কমাতে হবে, অপচয় ও লুণ্ঠন কমিয়ে সাপ্লাই চ্যানেলকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে।

ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের নতুন সমবায় কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা দর্শনগত সংকীর্ণতা ও পাশ্চাত্য নির্ভরতার দরুন এসব বিকল্প নীতিমালার প্রতি মনোযোগ দিতে পারছেন না। তাঁরা এই পথে এগোতে রাজিও নন। মুক্তবাজার পথকেই তাঁরা আদর্শ পথ হিসেবে বিবেচনা করেন, অথবা বড়জোর অধ্যাপক ইউনূস কথিত ‘মানবদরদি পুঁজিপতি’ বা ‘সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনিউর’দের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা। কিন্তু শ্রেণিচরিত্রের কারণে সেখানে কোনো সাড়া মিলছে না।

উপরন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া লুটপাটের বোঝা আরও জটিল হচ্ছে। তাঁদের কাছ থেকে বাস্তবে কোনো টাকা উদ্ধার করা যায়নি। বরং তাঁরা সব দ্রুত পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সে জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো এখন রীতিমতো বন্ধ হয়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছে। গত্যন্তর না দেখে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তাঁর পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতিতে তা ইনজেক্ট করেছেন। কিন্তু এই টাকার বড় অংশ সেখানে না দিয়ে উৎপাদনশীল খাতে দিলে হয়তো আরও ভালো ফল পাওয়া যেতো।

বৃহৎ ব্যক্তি খাতকে টাকা ছাপিয়ে বা জনগণের করের অর্থ থেকে অর্থ নিয়ে বেল-আউট করার এই কৌশল আমেরিকান। এই কৌশল ২০০৮ সালের পুঁজিবাদী বিশ্বের আর্থিক সংকটের সময় নেওয়া হয়েছিল। তা এখন আমাদের দেশে আবার ফিরে আসতে যাচ্ছে।

ক্রমাবনতিশীল শহুরে দারিদ্র্য ও করণীয়

বিআইডিএসের মতে, উৎপাদন খাতে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের চার সদস্যের পরিবারের জন্য বেঁচে থাকার ন্যূনতম মাসিক ব্যয় হচ্ছে ২২ হাজার ৯৭৯ টাকা। গবেষক আরও বলছেন যে কম খেয়ে, বেশি কাজ করে শ্রমিকেরা এ পরিমাণ টাকা আয়ের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু তারপরও উৎপাদন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (২০ শতাংশ) এ পরিমাণ টাকা রোজগার করতে পারেন না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন ছাঁটাইকৃত শ্রমিকেরা। তাঁরা বাধ্য হয়ে অটো বা রিকশা ভ্যান, ফেরিওয়ালা, কুলিগিরি, নির্মাণকাজ অথবা গ্রামে ফিরে কৃষি ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। তাঁদের সংখ্যাই বর্তমানে প্রধান। সমগ্র শ্রমিকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ। তাঁদের আয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব কম। সবনিম্ন দৈনিক ১০০ টাকা। সর্বোচ্চ দৈনিক ৫০০ টাকা।

এদিকে হাইকোর্টের এক রায়ে বিকল্প ব্যবস্থা না করেই অটোরিকশাশ্রমিকদের ওপর হঠাৎ করে বেকারত্বের খড়্গ চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবে বামপন্থীদের নেতৃত্বে বিপুল আন্দোলন হওয়ায় সেই রায় আবার প্রত্যাহার হয়েছে। তবে ২৫ ডিসেম্বর জানা যাবে চূড়ান্ত রায় ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ ক্ষেত্রে কী করবেন। এই ৬০ লাখ অটোরিকশাচালকসহ আড়াই কোটি শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য যতটুকু দেওয়া দরকার, ততটুকু সভ্য বুর্জোয়া তো বটেই প্রাচীন দাসমালিক এবং অভিজাত ভূস্বামীরাও দিতে কার্পণ্য করতেন না। কারণ, শ্রমশক্তির উৎস এই মানুষগুলোই হচ্ছে তাদের জন্য স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী হংসের মতো।

তাঁদের বাঁচিয়ে না রাখলে এবং কাজে না লাগালে তাঁরা তাঁদের মুনাফা, সুদ ইত্যাদি উদ্বৃত্ত আয় ও বিলাসব্যসন অব্যাহত রাখতে পারবেন না। কিন্তু অনুন্নত দেশের পরনির্ভর লোভী-লুটেরা বুর্জোয়া হাঁসটিকে মেরে একসঙ্গে সব ডিম আত্মসাৎ করতে চান। সে জন্য এখানে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা এক বিশেষ ধরনের নির্মম শোষণের শিকার হচ্ছেন। এখানে তাঁরা তাঁদের ন্যূনতম আয়টুকুও অব্যাহত রাখতে পারেন না। কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁদের তাই এখন ‘প্রলেতারিয়েত’ না বলে এমনকি উন্নত দেশেও নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রিকারিয়েত’।

এখন অনেক শিক্ষিত নিম্নবিত্ত এসে সেখানে যোগ হচ্ছেন। তাঁদের নতুন বাংলা নাম হচ্ছে ‘নিরাপত্তাহীন সর্বহারা’ বা ‘অনিশ্চিত ভাসমান শ্রমজীবী’। বাংলাদেশের উৎপাদনশীল আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক সর্বহারা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ‘নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত শ্রমজীবীর’ মিলিত বাহিনীটি এখন অতি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শতাংশে পরিণত হয়েছে। একার্থে তাঁরা কেউই কোনো না কোনোভাবে দারিদ্র্যের হুমকি থেকে মুক্ত নয়।

যদি আমরা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ও চাকরির নিরাপত্তাকে স্থায়ী ও একত্র করে দারিদ্র্য বিমোচনকে ’৭২-এর সংবিধানের আলোকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করি তাহলে এই প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই কমবেশি দরিদ্র বা নাজুক অবস্থার সম্মুখীন। সময় এসেছে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের মিলেমিশে এই অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অগ্রবাহিনী হিসেবে রুখে দাঁড়ানোর।

  • এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক