যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলে স্বনির্ভর হতে ব্যর্থ

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেলের মজুত ভান্ডার
রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্বালানির স্বনির্ভরতা’র সাধনা বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের মতো জো বাইডেনও তেল ইস্যুতে ওপেক দেশগুলোর কাছে ক্রমাগত নানা আবদার করেছেন এবং তারা তাঁর মনের মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

কিন্তু এখন একটি নতুন এবং অধিকতর সক্রিয় আমেরিকান তেল নীতি সবকিছু ওলটপালটের হুমকি দিচ্ছে। সৌদি আরব এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে ৫ অক্টোবর শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের জোট ওপেক প্লাস ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত কমানো লক্ষ্য ঠিক করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তেলের দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উচ্চমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া এবং চীন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ার কারণে ওপেক প্লাস জ্বালানি চাহিদা এবং বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগে পড়ে। ওপেক প্লাসের বৈঠকের ঠিক আগে জুনে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১২৪ ডলার থেকে ৮৪ ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র 8 নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে দাম এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।

এ লক্ষ্যে তারা তেলের উৎপাদন কমানোর বিরুদ্ধে জোর তদবির চালাচ্ছে। তারা যুক্তি দিচ্ছে, তেলের বাজারে এখন টান টান অবস্থা যাচ্ছে; ফলে ওপেক প্লাসের এ সিদ্ধান্ত অন্তত এক মাসের জন্য হলেও স্থগিত করা উচিত, যাতে রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর ইউরোপ যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের সেই আবেদন কাজে আসেনি। ওপেক প্লাস সিদ্ধান্ত বদল করেনি।

২০১০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকান ভূখণ্ড থেকেই বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আহরণ করেছিল। এটিকে মার্কিন ‘শেল বিপ্লব’ বলা হয়ে থাকে। এটি এই ভবিষ্যদ্বাণীর দিকে সবাইকে পরিচালিত করেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকে তেলের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে না। রিচার্ড নিক্সনের ‘প্রজেক্ট ইনডিপেন্ডেন্স’ শীর্ষক স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রকল্প গ্রহণের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে জ্বালানি নিরাপত্তাকে দেখেছিল। এক দশকের নিষ্ফল মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্টরা পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বিদেশি জ্বালানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন।

শেল বিপ্লবের এখনকার গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের প্রবৃদ্ধির চেয়ে নগদ অর্থের দিকে ঝোঁক বেশি। মার্কিন তেলের উৎপাদন আগামী কয়েক বছর ধরে বাড়তে থাকবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বা রাতারাতি মূল্য কমাতে তারা সমর্থ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র এখনো গুরুত্বপূর্ণ তেল রপ্তানিকারক দেশ। তবে ২০১০–এর দশকে তারা যেভাবে তেলের বিশ্ববাজারে দাম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখতে পারত, এখন আর তা পারে না।

বারাক ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাসের উৎপাদন তীব্রভাবে বেড়েছিল। তিনি অবশেষে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য ঠিক রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল রপ্তানির ওপর দীর্ঘদিন ধরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন। এটি ইরানের ওপর আরোপ করা কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলোকে কার্যকর করতে ভূমিকা রাখে এবং ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাতের সময় ও তার অব্যবহিত পরে লিবিয়ার তেল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার ক্ষতিকে পুষিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

বিশ্ববাজারে শেলের তেল ছাড়ার পরে শেলের সঙ্গে উপসাগরীয় উৎপাদকেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে এবং তারা অস্বাভাবিক কম দামে তেল বেচতে শুরু করে। এর ফল হিসেবে ২০১৪ সালে তেলের দামে ধস নামে এবং ‘ওপেক প্রাইস ওয়ার’খ্যাত মূল্যযুদ্ধ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের শেষের দিকে ওপেক প্লাস গ্রুপের সঙ্গে রাশিয়া এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নন-ওপেক উৎপাদক জোট বাঁধে। কারণ, সৌদি আরব দেখতে পাচ্ছিল ওপেকের পক্ষে যুগপৎভাবে শেল এবং রাশিয়ার সঙ্গে টক্কর দিয়ে চলা সম্ভব হবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধানত তেলের দাম মধ্যম মাত্রায় রাখার সুবাদেই তাঁর প্রেসিডেন্সির মেয়াদ উতরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ইরানের ওপর নবায়নকৃত নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে উৎপাদন বাড়াতে চাপ দিয়েছিলেন।

২০১৮ সালের নভেম্বরে উপসাগরীয় দেশগুলো উৎপাদন বাড়াতেই দাম আবার নিচে নেমে আসে। মহামারির প্রথম দিকে যখন তেলের দামে ধস নামে, তখন তিনি দেশীয় মার্কিন শিল্পকে বাঁচাতে ভ্লাদিমির পুতিন এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেন।

শেল বিপ্লবের এখনকার গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের প্রবৃদ্ধির চেয়ে নগদ অর্থের দিকে ঝোঁক বেশি। মার্কিন তেলের উৎপাদন আগামী কয়েক বছর ধরে বাড়তে থাকবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বা রাতারাতি মূল্য কমাতে তারা সমর্থ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র এখনো গুরুত্বপূর্ণ তেল রপ্তানিকারক দেশ। তবে ২০১০–এর দশকে তারা যেভাবে তেলের বিশ্ববাজারে দাম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখতে পারত, এখন আর তা পারে না।

আরও পড়ুন

তেলের উচ্চ মূল্য সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতির জন্য, বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো; কিন্তু ভোক্তাদের জন্য তা ভালো নয়। এটি মুদ্রাস্ফীতির জন্য এবং প্রধান তেল উৎপাদনকারী নয় এমন অঙ্গরাজ্যগুলোর জন্য খুবই খারাপ।

আর এই শ্রেণির অঙ্গরাজ্যগুলোর বেশির ভাগই ডেমোক্র্যাট সমর্থক গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। ফলে বাইডেন বেকায়দায় আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব এখন তার অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের জন্য তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে। এ কারণে দাম কমানোর জন্য সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে রাজি করানো বাইডেনের জন্য খুবই কঠিন।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • রবিন মিলস আবুধাবিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কামার এনার্জির প্রধান নির্বাহী ও দ্য মিথ অব দ্য অয়েল ক্রাইসিস বইয়ের লেখক