‘প্রতারিত’ পুতিন আলোচনায় বসতে রাজি!

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া পুরো মাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এই প্রথম পশ্চিমা কোনো সাংবাদিকের মুখোমুখি হলেন।

৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন উপস্থাপক ট্যাকার কার্লসন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দুই ঘণ্টার একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া পুরো মাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এই প্রথম পশ্চিমা কোনো সাংবাদিকের মুখোমুখি হলেন।

পুতিনের এই সাক্ষাৎকার পশ্চিমে প্রচুর হাসিঠাট্টার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্বে পুতিন যেভাবে রুশ-ইউক্রেনীয় ইতিহাস নিয়ে ৩০ সেকেন্ড কথার বলার পর ৩০ মিনিট ধরে রাশিয়ার মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহ এবং বহু বছর আগে বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছেন, তা নিয়ে প্রচুর হাসিঠাট্টা চলছে।

পুতিনের কিছু দাবি ছিল সরাসরিভাবে দুঃখজনক। এই যেমন তিনি বলেছেন, পোল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তার কারণ হলো হিটলারের দাবি পূরণ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল।

পুতিনের সাক্ষাৎকার পশ্চিমাদের বিদ্রূপের অনেক খোরাক জোগালেও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বার্তাও আছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকদের খারিজ করে দেওয়ার মনোভাবের কারণে সেই বার্তাগুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর পুতিনের সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো, পুতিন তাঁর নিজের শর্তে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান।

পুরো সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এমন একটা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে পশ্চিমাদের কাছে অব্যাহতভাবে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। আবার যেন প্রতারিত না হতে হয়, এমন একটি সুস্পষ্ট সমাধান চান তিনি—এমন মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন পুতিন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ২০০৮ সালে ন্যাটোর বুখারেস্ট সম্মেলন নিয়ে কথা বলেন। ওই সম্মেলনে ন্যাটোয় ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে সময় জার্মানি ও ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল এবং ইউক্রেনীয়দের খুব সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাতে সমর্থন দিয়েছিল। পুতিনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ন্যাটোর ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে একের পর এক যে প্রভাব পড়ে, সেগুলোই চূড়ান্তভাবে ইউক্রেন সংঘাতের জন্ম দেয়।

ভালো বিশ্বাস থেকেই হোক আর মন্দ বিশ্বাস থেকেই হোক, সাক্ষাৎকারে পুতিন যে বার্তা দিতে চেষ্টা করেছেন, তা হলো ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আরও দুর্ভোগে যাতে না পড়ে, সেটা বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে ইউক্রেনের। পুতিন তাঁর সাক্ষাৎকারে বার্তা দিয়েছেন, আলোচনার জন্য প্রস্তুত তিনি।

কার্লসনকে পুতিন বলেন যে জার্মান ও ফ্রান্সের সরকারপ্রধানেরা তাঁকে বারবার করে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ন্যাটোয় ইউক্রেনকে সত্যি সত্যি যুক্ত করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাঁদের সেই আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো কারণ ছিল না। পুতিনের প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র যদি চাপ দিয়ে তাঁদের ইউক্রেনের আমন্ত্রণের ব্যাপারে সম্মতি আদায় করে নিতে পারে, তাহলে ন্যাটোয় ইউক্রেনের সত্যি সত্যি যোগ না দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা কোথায়?

সাক্ষাৎকারের পরের দিকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনীয় সরকার ও বিরোধীদের মধ্যকার চুক্তির ব্যাপারে কথা বলেন। মায়দান বিপ্লব নামে পরিচিত সেই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তে পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় সহিংসতা অবসানে একটি চুক্তি হয়। পুতিন বলেন যে সেই চুক্তি মেনে না চলে বিরোধীপক্ষ ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ সরকারকে উৎখাত করে। পুতিনের মতে, পশ্চিমা গ্যারান্টররা চুক্তিতে ‘অগ্নিকুণ্ডে’ নিক্ষেপ করে।

পুতিন তাঁর ইতিহাসবিষয়ক ‘বক্তৃতামালার’ শেষ পর্যায়ে এসে ২০২২ সালের মার্চ মাসে ‘ইস্তাম্বুল সংলাপ’ নিয়ে কথা বলেন। সেখানে চলমান ইউক্রেন সংঘাতের পরিসমাপ্তির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন পুতিন। তাঁর দাবি, পশ্চিমা নেতাদের জিদের কারণে তিনি কিয়েভের চারপাশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেন শান্তি আলোচনার সুবিধার্থে। পক্ষান্তরে পশ্চিমা নেতা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নির্দেশে ইউক্রেনীয়রা সেই চুক্তিকে খাদে ছুড়ে ফেলে।

কিন্তু পুতিনের দাবি খুব কমই বিশ্বাসযোগ্য। কেননা উত্তর ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর গেরিলা কৌশলের কাছে রুশ বাহিনী চরমভাবে মার খাচ্ছিল। রুশ বাহিনীকে সেখান থেকে এমনিতেই সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হতো। কিন্তু পুতিন আবারও নিজেকে জাহির করার সুযোগ পেলেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে পুতিন তাঁর সম্পর্ককে অপমান ও প্রতারণার ইতিহাস হিসেবে দেখেন। আর এসব অপমান ও প্রতারণা তিনি ফিরিয়ে দিতে চান তাঁর নিজস্ব কায়দায়। সেটা চোখের বিনিময়ে চোখ—এমনটা নয়, কিন্তু কোনো বাধা না মেনে বা কারও কথা তোয়াক্কা না করে ত্বরিত শাস্তি চাপিয়ে দেন। এখন পর্যন্ত পুতিনেব নীতি (নিদেনপক্ষে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) সব সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের পাল্টা, আগ বাড়িয়ে নেওয়া পদক্ষেপ নয়।

ভালো বিশ্বাস থেকেই হোক আর মন্দ বিশ্বাস থেকেই হোক, সাক্ষাৎকারে পুতিন যে বার্তা দিতে চেষ্টা করেছেন, তা হলো ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আরও দুর্ভোগে যাতে না পড়ে, সেটা বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে ইউক্রেনের। পুতিন তাঁর সাক্ষাৎকারে বার্তা দিয়েছেন, আলোচনার জন্য প্রস্তুত তিনি।

  • লিওনিড রাগোজিন লাটভিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
    আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত