দুর্ঘটনার দায়: শোক করার অধিকারটুকুও কি থাকবে না?

২২ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্তানের এই ছবিটি পোস্ট করে নূর এ আলম তৈমুর লিখছেন ‘বাবার মাফলার পরে বড় হয়ে যাচ্ছে কে?’

নূর এ আলম তৈমুর। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা। তৈমুরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না; কিন্তু সে আর আমি একই বিভাগের ছাত্র। আমাদের মধ্যে কালের ব্যবধান ছিল ছয় বছর। ফলে তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই, কিন্তু ট্রেনে কাটা পড়ে তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা যে বক্তব্য দিলেন, তা নিয়ে এ লেখা।

ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর পর পুলিশ সচরাচর যা বলে থাকে, এখানেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। যেন অনেকটা দায়সারাভাবে বলে দিল, তৈমুর কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছিল। এ কারণে পেছন দিক থেকে আসা ট্রেনের শব্দ সে শুনতে পায়নি। রেলওয়ে পুলিশের সেই বক্তব্য আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো হুবহু ছেপে দিল, প্রাথমিকভাবে একটু অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না।

আপনজনের মৃত্যুর পর শোক বড় দুর্বহ হয়ে ওঠে। তারপর যদি এমন অপরিণত বয়সে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়, তাহলে সেই শোকের ভার বহন করা প্রকৃতপক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। স্বামী হারিয়ে তৈমুরের স্ত্রী যখন দিশাহারা, তখন দুর্ঘটনার দায় তৈমুরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তাঁর স্ত্রীর মনে কী ঘটে চলছে, সংবেদনশীল মানুষমাত্র তা অনুভব করতে পারেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে তৈমুরের স্ত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা গেল, বিষয়টি মোটেও সে রকম ছিল না। বরং আমরা জানতে পারছি, মধ্যবয়সী এক নারী রেললাইনের একদম কাছে চলে গিয়েছিলেন। তখন একদিক থেকে ট্রেন আসছিল। সেই নারীকে বাঁচাতে ছুটে যান তৈমুর। সেই নারী রক্ষা পেলেও বিপরীত দিক থেকে আসা অপর ট্রেনে কাটা পড়েন তৈমুর। আরও অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তৈমুরের ল্যাপটপ, মানিব্যাগ, মুঠোফোন কোনো কিছুই খোয়া যায়নি অথচ রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্যের সেই হেডফোন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তৈমুরের স্ত্রী সৈয়দা মাসনুনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে আমাদের সংসার শুরু হয়। সংসারজীবনে আমি কখনো দেখিনি হেডফোন দিয়ে ওকে মোবাইলে গান শুনতে। মিটিং করতে খুব প্রয়োজন হলে সে ইয়ার বাড ব্যবহার করত। দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইলটি পেয়ে তখনই নম্বর, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সব চেক করেছি। দুর্ঘটনার আগপর্যন্ত মঙ্গলবার কারও সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়নি। তাহলে কানেই বা ফোন থাকবে কেন রেললাইন অতিক্রমের সময়?’

অর্থাৎ দুর্ঘটনার দায় এককভাবে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তির ওপর চাপানো হলো। এর মধ্য দিয়ে যাঁরা মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁরা নিজেদের দায় এড়িয়ে গেলেন।

আপনজনের মৃত্যুর পর শোক বড় দুর্বহ হয়ে ওঠে। তারপর এমন অপরিণত বয়সে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সেই শোকের ভার বহন করা প্রকৃতপক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। স্বামী হারিয়ে তৈমুরের স্ত্রী যখন দিশাহারা, তখন দুর্ঘটনার দায় তৈমুরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তাঁর স্ত্রীর মনে কী ঘটে চলছে, সংবেদনশীল মানুষমাত্র তা অনুভব করতে পারেন। তৈমুরের স্ত্রীর এখন শোক করার সময়, কিন্তু পুলিশের এই ‘দায়িত্বহীন মন্তব্যের’ কারণে তাঁর পক্ষে অবিমিশ্র শোক করাও সম্ভব হচ্ছে না।

তৈমুরের ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে রেলওয়ে পুলিশ যা বলেছে, তা যে আমার বাংলাদেশে ঘটে না, সেটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা ঘটে থাকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, রেললাইনের আশপাশে ২০ ফুট দূরত্বের মধ্যে কোনো স্থাপনা ও প্রাণী চলাচল যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ রেললাইন একরকম অরক্ষিত পড়ে থাকে। এমনকি অনেক লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত পড়ে থাকে এবং সে কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে, এমন নজিরও আছে। বাংলাদেশ থেকে মাত্র কয়েক শ কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রেললাইন কোথাও এমন অরক্ষিত পড়ে থাকে বলে চোখে পড়েনি, উন্নত দেশের কথা তো বলাই বাহুল্য।

আরও পড়ুন

কিন্তু আমাদের দেশের রেললাইনের পাশের জমি যেন সোনার খনির মতো, সেখানে চায়ের দোকান বসানো হবে, সেখানে বাজার বসানো হবে এবং ট্রেন এলে মানুষ হুটহাট সরে যাবে—এই যেন আমাদের স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন না করা দেশে যে স্বজনতোষী ব্যবস্থা করে উঠেছে, তার অংশ হয়ে উঠেছে। নিজেদের অবহেলা ঢাকতে এভাবে ঢালাওভাবে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ওপর দায় চাপাতে তাঁদের বাধে না। এমনকি দুর্ঘটনাস্থল থেকে তৈমুরের নিথর দেহ সরাতে খোদ রাজধানীতে চার ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়।

শেষমেশ তাই অনুরোধ, মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে না পারলেও স্বজনদের অন্তত শোক করার সুযোগটা দিন, শেমিং করবেন না। ‘আমার ছেলে প্রথম মাটি ধরল বাবাকে কবর দিতে’, তৈমুরের স্ত্রীর এই মর্মান্তিক কথার অর্থ বোঝার মতো সংবেদনশীলতা যেন আমাদের থাকে।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক