রাষ্ট্র ও সাংবাদিকতা: সাংবিধানিকতা কোথায়?

রাজা আর রাষ্ট্র একসময় একাকার ছিল, রাজার কাজই রাষ্ট্রের কাজ বিবেচিত হতো। সময় বদলেছে তবে বদল আসেনি রাজদাপটে বা রাজরোষে। সময় এখন এমনই যে রেফারেন্সে উল্লেখ না করলে সমূহ সমস্যার (মামলার) উদ্ভব হতে পারে। সংবাদ বা সংবাদভাষ্যের শব্দরা সব জড়বৎ, মৃতপ্রায়। সমূহ সম্পাদনায় নখদন্তহীন সন্দর্ভের কঙ্কাল যেন। শব্দ, বাক্য বা বক্তব্য যেন কারও ভাবমূর্তির ব্যাঘাত না ঘটায়, সে জন্য তটস্থ থাকতে হয় সদা। কনটেন্ট রাইটিং আর প্রোডাক্ট রিভিউ যেন আমাদের নিয়তি। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কিছু ছাড় পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু যেকোনো দিন সেন্সরের কবলে পড়তে পারে ওটিটিও। সম্পাদকীয় বা শৈল্পিক কটাক্ষ বলে কিছুই আর থাকবে না।

সাংবাদিকতা হচ্ছে ফার্স্ট ড্রাফট অব হিস্টরি। সেই ধারা জারি রাখতেই কি রোজিনা ইসলাম সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন এক আইনের মামলায় অভিযুক্ত হলেন, যাতে এর আগে কোনো মামলাই হয়নি। ২০২১ সালের ১৭ মে বিকেলে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন সাংবাদিক রোজিনা। তাঁকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে রাত সাড়ে আটটার দিকে সচিবালয় থেকে পুলিশি পাহারায় শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। ওই দিন রাতেই রোজিনার নামে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। দণ্ডবিধির ৩৯৭ এবং ৪১১ ধারা, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ৩/৫-এর ধারায় এ মামলা করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন উপসচিব।

এই মামলা দায়ের-পূর্ব ঘটনাপ্রবাহ স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য যেকোনো বিচারে অবমাননাকর। ন্যূনতম আইন ও সংবিধানবোধের উপস্থিতি থাকলে এমন কিছু ঘটা সম্ভব ছিল না। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বলছে...
“৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।”

রোজিনা ইসলামের মামলাটি এখনো বিচারাধীন, তাই কোর্ট রুম প্র্যাকটিশনার হিসেবে বিচারাধীন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা না-করার অস্বস্তি বিবেচনায় মনে পড়ে আমেরিকান বিচারপতি কর্ডোজার সেই সেভিং ক্লজের মতো রক্ষাকারী কবচ বচন, বিচারে মামলার বিবদমান ব্যক্তিদের স্বার্থ ছাড়াও আরও যে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে ‘জনস্বার্থ’। আপামরের স্বার্থ বা জনস্বার্থ সেই মৌলিক প্রত্যয়, যা একটি কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম মানদণ্ড।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারে সংক্ষুব্ধ এক নাগরিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে লেখেন...সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যখন লকআপে সাংবাদিক, তখন ৩৯ অনুচ্ছেদের বক্তব্যের পেট চিরে (অক্ষর কেটে দিয়ে) দেওয়াই দস্তুর। কিন্তু অক্ষরের কী দোষ? অক্ষরসমূহ শব্দ হয়ে বোধের সীমানা না পেরুতে পারলে অক্ষরেরই দোষ। রক্তজবার ক্ষত নিয়ে পড়ে আছে সংবিধানের আহত সব অনুচ্ছেদ।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে আচরণ, তা রাষ্ট্র হিসেবে অনুমোদন করা আন্তর্জাতিক সনদের বরখেলাপ। উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহারবিষয়ক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা জাতিসংঘ সনদের ২ (১) ও ৪ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩-এর ধারা ৯ অনুযায়ী, এই কাজ ফৌজদারি অপরাধ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জন্যই বলেছেন, বহির্বিশ্বে এসবের জবাব দিতে হচ্ছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর নানা রচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের করণীয় নির্ধারণ করে গেছেন। তিনি প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছেন প্রজাতন্ত্র কীভাবে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। ম্যাকিয়াভেলি বলেন, প্রজাতন্ত্রকে যাত্রার সূচনাবিন্দু মনে রেখে সময়ে-সময়ে তার সংস্কার সাধন করতে হবে অর্থাৎ প্রজাতান্ত্রিক শাসন যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, ঠিক সেখানেই তার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় এই শাসনের নব রূপায়ণ। রোমান প্রজাতন্ত্রের শাসন শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলা এবং আবার শৃঙ্খলার বৃত্ত পূর্ণ করে  এই সময় পর্যন্ত উদাহরণ হয়ে আজও দিশা দেয়। কিন্তু আমরা যেন যাত্রা করেছি পেছনমুখী। ভুলে যাই প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উদার গণতন্ত্রের আবশ্যিক স্মারক।

রোজিনা ইসলামের মামলাটি এখনো বিচারাধীন, তাই কোর্ট রুম প্র্যাকটিশনার হিসেবে বিচারাধীন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা না-করার অস্বস্তি বিবেচনায় মনে পড়ে আমেরিকান বিচারপতি কর্ডোজার সেই সেভিং ক্লজের মতো রক্ষাকারী কবচ বচন, বিচারে মামলার বিবদমান ব্যক্তিদের স্বার্থ ছাড়াও আরও যে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে ‘জনস্বার্থ’। আপামরের স্বার্থ বা জনস্বার্থ সেই মৌলিক প্রত্যয়, যা একটি কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম মানদণ্ড। ব্যক্তিস্বার্থের ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে জনস্বার্থের উপস্থিতি এবং সেখানে জনস্বার্থ মুখ্য বিধায় আদালতের রায়ের পূর্বে ও পরে ন্যায্য আলোচনা ও মন্তব্য অবশ্যই অনুমোদনযোগ্য।

আদালতের রায়ের নেতিবাচক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারার সম্ভাব্যতা বিষয়ে বিখ্যাত কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরালা  মামলার একটি উদ্ধৃতি, যেখানে বলা হয়েছিল: ‘সংবিধানের যে কোনো ব্যাখ্যার রাজনৈতিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া থাকার বাস্তবতা যেন এই সত্যকে মুছে না দেয় যে, আদালতের প্রধান কর্তব্য হলো ভীতি বা পক্ষপাতমুক্ত থেকে সংবিধান ও আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।’

রাষ্ট্র নির্মাণের পরিক্রমায় এর নাগরিকদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের নিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বিপরীতে রাষ্ট্রের ‘বৈধ সহিংস ক্ষমতা’ প্রয়োগের সুসংহতকরণ (কনসোলিডেশন অব লেজিটিমেট ভায়োলেন্স কেপাবিলিটি অব দ্য স্টেট) প্রবণতা থেকেও মুক্ত থাকার নৈতিক অনুশীলন জারি রাখতে হয়। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করাই আধুনিক রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ। আমাদের মতো দেশগুলোতে এই ভারসাম্য প্রায়ই রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

গত মার্চে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে দীপেশ চক্রবর্তী বলেন, মানুষ সবচেয়ে বেশি আশা করে ন্যায়বিচার। কারণ, এটা সবচেয়ে দুর্মূল্য। নিজে যদিও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে নিশ্চিতভাবে সেটা দীপেশের ভাষায় ‘হতে পারত ইতিহাস’-এর এক প্রত্যয়। ‘হতে পারত ইতিহাস’ না হওয়া দেখে আর হওয়া ইতিহাস লুণ্ঠিত হতে দেখে আমরা কুণ্ঠিত এই সমকালে বাঁকে ও কলমে।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট