জুমে লিংক পাঠিয়ে আমি আমার ছাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি তাদের ইংরেজির শিক্ষক। তারা যে অপেক্ষায় আছে, একটু পর সেই নোটিফিকশন আমি পেলাম। বড় একটি হাসি দিয়ে আমি ক্লাস শুরু করলাম। ইংরেজিতে তাদের স্বাগত জানালাম।
আমি জানি, তারা আমার হাসিমুখ দেখতে পায়নি। কেননা, নিরাপত্তার কারণে আমি ক্যামেরা চালু করিনি। কিন্তু আমি জানি, তারা আমার হাসির শব্দ শুনেছে। আমি জানি, আমার ছাত্রীদের মনোবল ঠিক রাখতে আমার যা কিছু করার, তার সবকিছুই করি। অবশ্য আমার মনোবল ঠিক রাখার জন্যও আমি সেটি করি।
২০২১ সাল থেকে আমরা দুটি শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছি। প্রথমটি হলো, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে মেয়ে ও তরুণীদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করে তালেবান। দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের হতাশা ও অসহায়ত্ব। এ দুটি শত্রুকেই ধীরে ধীরে আমরা জয় করার চেষ্টা করে চলেছি।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (ইউনেসকো) তথ্যমতে তালেবানের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২৫ লাখ মেয়ে ও তরুণী বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রতি তিনজন তরুণীর মধ্যে একজন তরুণী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার জন্য নাম নিবন্ধন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রায় এক লাখ তরুণীর ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, যেসব নারী শিক্ষার্থী বিদেশে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের পড়াশোনার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দেয় তালেবান কর্তৃপক্ষ।
ইসলামি পণ্ডিতেরা বারবার বলে আসছেন, ধর্মে নারীশিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলেও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কোনো অর্থ নেই। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) হিসাব বলছে, মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা–নিষেধাজ্ঞায় বছরে আফগানিস্তানের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ক্রমাগত আবেদনের পরও তালেবান সরকার তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে রাজি হয়নি। আফগান মেয়ে ও তরুণীরাও তাদের দিক থেকে আশা ছেড়ে দেননি।
অনেকেই ভবিষ্যতের আশা দেখতে পাচ্ছেন না। আমার ছাত্রীদের অনেকেই আশা দেখছে না। আমি মাঝেমধ্যেই তাদের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করি। তাদের ভোগান্তি আর হতাশার গল্প শুনি। ওরা আমাকে বলেছে, যা কিছু ঘটেছে, তার জন্য নিজেদের ভাগ্যকে তারা দোষ দেয়, না হয় মজা করে। তারা বলে, কঠের পরিশ্রম আর বড় স্বপ্ন দেখতে পারাটাই সব খারাপ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ।
শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষার প্রতি আকাঙক্ষা এতটাই তীব্র যে তালেবান সরকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই কিছু শিক্ষক নিজেদের সংগঠিত করেন এবং অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। প্রথমে এটা মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি দেড় বছর আগে।
ছাত্রীদের আমরা ইংরেজি পড়াই। উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী অন্য সব বিষয়গুলো পড়াই। বাড়তি কিছু বিষয় যেমন কম্পিউটার দক্ষতার ওপর ক্লাস নিই। আমাদের এই অনলাইন ক্লাসের কথা যতই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, ততই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪০০ শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এই উদ্যোগে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে করি। কেননা, এর মাধ্যমে আমার পরিবারের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সামান্য অবদান রাখতে পারছি। একই সঙ্গে যেসব মেয়ে পড়তে চায়, তাদের পড়ানোর একটি সুযোগ আমি পেয়েছি।
২০২১ সালের আগেই শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। একদিন শিক্ষক হব, সেটি ভেবে আমি এই প্রশিক্ষণ নিইনি। আমার বাবা আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি তাঁর উপদেশ মেনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম।
শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়। আরও ভালোভাবে শেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করা যায়, সেটি আমাদের শেখানো হয়েছে। কিন্তু আমি সেখানে যা শিখেছি, সেটি প্রয়োগ করতে হলে স্বাভাবিক অবস্থা প্রয়োজন। একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি দরকার। কিন্তু খুবই বাজে ইন্টারনেট সংযোগ যেখানে, সেখানে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া রীতিমতো যুদ্ধের, সেখানে এ ধরনের কিছু করা মোটেও সম্ভব নয়।
এ কারণে আমি যখন অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছিলাম, সেটি ছিল রীতিমতো আমার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। আমি বারবার সমস্যায় পড়েছি। বারবার আমার মনে হয়েছে, সবকিছু ছেড়ে দিই। কিন্তু ছাত্রীদের অদম্য যে ইচ্ছাশক্তি আমি দেখছি, সেটিই আমাকে সামনে এগোতে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি একটি পথ খুঁজে নিয়েছি।
কয়েক দিন আমার এক ছাত্রী আমাকে লিখেছে, ‘আমার যখনই মনে হয়েছে, আমি আর পড়তে পারব না, আপনি আমাকে কোনো না কোনোভাবে পথ দেখিয়েছেন। বলেছেন, তুমি পারবে। আপনিই আমার জীবনের সেরা রোল মডেল।’ এ ধরনের বার্তা আমার হৃদয় সত্যি সত্যি আর্দ্র করে তোলে। সামনে চলবার প্রেরণা দেয়।
কয়েক দিন আগে আরেক ছাত্রী আমাকে লিখেছে, ‘প্রিয় শিক্ষয়িত্রী, আমাকে যদি স্কুলে পড়ার অনুমতি দিত, তাহলে আজ থেকে দুই বছর পর আমি আমার স্কুলের শিক্ষা শেষ করতে পারতাম। কিন্তু তাতে তো কোনো লাভ হতো না। কেননা, আমাকে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দিত না। আবার ধরুন, আমি যদি কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারতাম, তাতেই বা কী লাভ হতো। আমাকে তো আর চাকরি করার অনুমতি দিত না।’
এই প্রশ্নে কার মন না ভেঙে পড়ে! আফগানিস্তানের অগুনতি মেয়ে আর তরুণীর একেবারে মনের প্রশ্ন এটি। কারাগারের মতো পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হওয়ায় আজ আফগানিস্তানের অনেক মেয়ে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। স্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, আফগানিস্তানের মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার কথা বলা কিংবা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করার ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
অনেকেই ভবিষ্যতের আশা দেখতে পাচ্ছেন না। আমার ছাত্রীদের অনেকেই আশা দেখছে না। আমি মাঝেমধে৵ই তাদের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করি। তাদের ভোগান্তি আর হতাশার গল্প শুনি। ওরা আমাকে বলেছে, যা কিছু ঘটেছে, তার জন্য নিজেদের ভাগ্যকে তারা দোষ দেয়, না হয় মজা করে। তারা বলে, কঠের পরিশ্রম আর বড় স্বপ্ন দেখতে পারাটাই সব খারাপ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ।
মরিয়ম আহমাদি (ছদ্মনাম), আফগানিস্তানের একজন শিক্ষা ও শান্তিকর্মী
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত