ভূমিকম্প: জাপান, হাইতি ও চিলি থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা

২০১১ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত জাপানের একটি এলাকাছবি: রয়টার্স

২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের সেন্দাই শহরে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, যার মাত্রা ছিল ৯.১। ভূমিকম্পটি শুরু হয় বেলা ২টা ৪৬ মিনিটে এবং স্থায়ী হয় ৬ মিনিট। অসংখ্যবার আফটারশক (পরাঘাত) হয়, যেগুলোর কোনো কোনোটির মাত্রা ছিল ৭-এর ওপরে। ওই ভূমিকম্পে প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায়।

তখন ছিল শীতকাল, তাপমাত্রা থাকত মাইনাস ও মাঝেমধ্যে বরফ পড়ত। আমি তখন ওই শহরের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলাম এবং পরিবার নিয়ে সেখানে ছিলাম।

ভূমিকম্পের সময় আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, আমার স্ত্রী বাসায় আর আমাদের চার বছরের মেয়ে তার স্কুলে। আমি ক্যাম্পাসে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম সদ্য নির্মিত বড় একটি গেমস রুমে। আমি দৌড়ে কাঠের একটি শক্ত কাঠামোর নিচে শুয়ে ছিলাম ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত। এরপর বাইরে বের হয়ে অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি।

আমার স্ত্রী বাসায় থাকার কারণে ভূমিকম্পের তীব্রতা বেশি টের পেয়েছে। আমাদের বাসা ছিল দোতলায়। ভূমিকম্প শুরু হলে সে একটি শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেয়। ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে তার চোখের সামনে বাসার ফ্রিজটি কয়েক ফুট সামনে চলে যায় এবং একটি বড় বুকশেলফ রুমের এক কোণ থেকে মাঝখানে চলে আসে। পানির কল নিজে নিজে খুলে যায় ও পানি পড়তে শুরু করে।

আরও পড়ুন

ভূমিকম্প থামার পর ইন্দোনেশিয়ান এক প্রতিবেশীর সঙ্গে সে দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে। এরপর আমার স্ত্রী মেয়েকে আনতে স্কুলে চলে যায়। স্কুল থেকে তাকে জানানো হয়, ভূমিকম্পের সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছিল। যেহেতু সুনামির সতর্কবার্তা ছিল তাই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের হস্তচালিত গাড়িতে বসিয়ে উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পরে সতর্কবার্তা তুলে নেওয়ায় শিশুদের ক্লাসরুমে নিয়ে আসা হয়।

আমাদের বাসার মালিকের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম বাসায় থাকা অনিরাপদ হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেলাম। আশপাশের স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। স্কুলগুলো ওভাবেই তৈরি করা। আমরা তিন দিন সেখানে ছিলাম। আমাদের নিয়মিত দুই বেলা খাবার দেওয়া হয়েছে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে খাবার নিয়েছি। মুঠোফোনে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে অনেকগুলো অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিল। একসময় আশ্রয়কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগে যায়। আগুন লাগার মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও হেলিকপ্টার চলে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আশপাশের দোকানগুলোতে খাবার কেনার লাইন পড়ে যায়। সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় শুকনা খাবার, বাচ্চাদের দুধ ও ওষুধ কিনে নেয়।

আরও পড়ুন

ভূমিকম্পের পর কোনো কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে তারা আর পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি। কেউ কেউ ডিগ্রি শেষ না করেই যার যার দেশে ফিরে যায়। যারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের পরামর্শের ব্যবস্থা করা হয়। এক বছর পর যেসব শিক্ষার্থী এই ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তাদের ওপরে একটা জরিপ করা হয়।

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে উঠি, তখন আমাদের বাসাটির সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে আমরা ভূমিকম্পের সময় সেখানে আশ্রয় নিতে পারি। এ-ও বলা হয়েছিল যে ওই ছাত্রাবাসগুলো ৭ মাত্রার ভূমিকম্প–সহনীয় করে তৈরি করা হয়েছে। অথচ ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পরেও সেগুলো অক্ষত ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রুমে আমরা পড়াশোনা করতাম, সেখানে প্রত্যেক টেবিলে একটি করে হেলমেট দেওয়া ছিল, যাতে ভূমিকম্প হলে আমরা ওটা পরে টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে পারি। টেবিলগুলোও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। ভূমিকম্প হলে কী কী করতে হবে সে নির্দেশনাও ছিল। যেমন তিনতলা কিংবা তার ওপরে যারা ছিল, তাদের ভূমিকম্পের সময় দৌড়ে নিচে না নামার নির্দেশনা ছিল। প্রত্যেক ফ্লোরের কোন কোন জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে তা নির্দিষ্ট করা ছিল। সবাই একত্রে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে কী বিপদ ঘটতে পারে সে ব্যাপারেও শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ওই বিল্ডিংটিতে ভূমিকম্প হওয়ার দশ সেকেন্ড আগে সতর্কবার্তা পেতাম।

২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার।
ছবি: এএফপি

জাপানের স্কুলগুলোতে শিশুদের ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে যাবতীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আবার কৃত্রিমভাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি করে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করা হয়। এ সময় তারা যা শিখেছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রায় প্রত্যেক বাসায় শুকনা খাবারের একটি প্যাকেট প্রস্তুত করে রাখা হয়, সঙ্গে কিছু কাপড়চোপড়। ভূমিকম্প হলে তারা ওই ব্যাগটি নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে পারে।

জাপানে রাস্তাঘাট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রত্যেক বাসা পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ঢুকতে পারে। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্মাণবিধি মানতে হয়। ফলে ভূমিকম্পের ক্ষতি হয় ন্যূনতম। তারা সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক উঁচু ভবন তৈরি করেছে, যা ভূমিকম্পের সময় দুলবে কিন্তু ভাঙবে না।

২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার। মৃত্যুর কারণ যতটা ছিল ভূমিকম্পের প্রভাবে, তার চেয়ে বেশি ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত নির্মাণশিল্প তথা আবাসিক খাতের কারণে। পৃথিবীতে নির্মাণশিল্প হলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত; কালোটাকা এখানে বিনিয়োগ করা হয়।

২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার। মৃত্যুর কারণ যতটা ছিল ভূমিকম্পের প্রভাবে, তার চেয়ে বেশি ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত নির্মাণশিল্প তথা আবাসিক খাতের কারণে। পৃথিবীতে নির্মাণশিল্প হলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত; কালোটাকা এখানে বিনিয়োগ করা হয়।

হাইতিতেও একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। দুর্নীতির প্রকোপ এসে পড়েছিল নির্মাণশিল্পে। দুর্নীতির টাকা ব্যাপকভাবে আবাসনশিল্পের চাহিদা তৈরি করেছিল। সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খেয়ে ঠিকাদারদের দালান তৈরির অনুমতি দিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে জমি ভরাট করা হয়েছিল বিধিবিধান না মেনে; দালানের নকশা ছিল ত্রুটিপূর্ণ; দালান তৈরির উপকরণ ছিল নিম্নমানের।

অন্যদিকে ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চিলিতে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। চিলির নির্মাণশিল্প ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। তাদের ভবন নির্মাণবিধি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। ভূমিকম্প–প্রতিরোধী ভবন তৈরি ছিল বাধ্যতামূলক। নির্মাণশিল্পের নিলাম, অনুমতি, নির্মাণকালীন তদারকি ও পরিদর্শন ছিল অত্যন্ত কঠোর। সর্বোপরি, দেশে আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচার বিভাগ ছিল। ফলে তাদের নির্মাণশিল্পের মান ছিল অনেক উন্নত। তাই তাদের দেশে বড় ভূমিকম্প হলেও হাইতির মতো ব্যাপক ভবনধস ঘটেনি। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫০।

নিকোলাস এম্ব্রাসেস ও রজার বিলহ্যাম ২০১১ সালে দুর্নীতি ও ভূমিকম্পে জীবনহানি নিয়ে নেচার–এ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাঁরা দেখান, নির্মাণশিল্পের দুর্নীতি ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যাকে ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দেয়। ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা যতটা ভূগোল নিয়ন্ত্রিত, তার চেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট—নির্মাণশিল্পের দুর্নীতির মাধ্যমে।

দুর্নীতির সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণশিল্পের সম্পর্ক দেখতে যে সময়ে ভবনগুলো তৈরি হয়েছে, সে সময়ের দুর্নীতি বিবেচনায় নিতে হবে। উপসংহারে তাঁরা বলেন, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণশিল্প একটি সম্ভাব্য খুনি এবং কোনো সমাজের সার্বিক সততা তার নির্মাণশিল্পের সততার থেকে বেশি শক্তিশালী হয় না।

বাংলাদেশ এক সময় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এরপরেও আমাদের দেশে দুর্নীতির মাত্রা একটুও কমেনি। তবে আমরা প্রথম স্থান ধরে রাখতে পারিনি অন্যান্য দেশের দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে।

গত আড়াই দশকে আমাদের দেশে দুর্নীতির সঙ্গে নির্মাণশিল্পও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। জলাশয় ভরাট করা হয়েছে আবাসনশিল্পের জন্য; ভবন তৈরির বিধি সঠিকভাবে মানা হয়নি; নির্মাণশিল্পের উপকরণ কেমন ছিল তা আমরা জানি না। যদি ভূমিকম্পের মাধ্যমে আমাদের নির্মাণশিল্পের মান যাচাই করতে হয়, তবে তা হবে আমাদের জন্য ভয়াবহ। এ বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। সবাই মিলে যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত না করে উপায় কী!

  • ড. মো. মাইন উদ্দিন অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়