নিয়মিত রক্তদান একটি ভালো অভ্যাস

রক্তদান করা কোনো দুঃসাহসিক বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কাজ নয়। বরং এর জন্য একটি সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ট।
ফাইল ছবি

আজ ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। প্রতিবছরই এ দিনটি বিশ্ব রক্তদান দিবস পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও নিঃস্বার্থ উপহার হলো রক্তদান। মূলত থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অগণিত মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে পর্দার আড়ালে থাকা যেসব হৃদয়বান স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদান করেন, তাঁদের দানের মূল্যায়ন, শ্রদ্ধা জানাতে, স্বীকৃতি দিতে সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ যাঁরা রক্তদানে ভয় পান, তাঁদের ভয় দূর করে রক্তদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালন করা হয়।

এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো—জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করা, স্বেচ্ছায় রক্তদানে সচেতন করা, নতুন রক্তদাতা তৈরি করা ও নিরাপদ রক্ত ব্যবহারে উৎসাহিত করা। এ দিবস পালনের আরও একটি উদ্দেশ্য দেশের জনগণকে প্রাণঘাতী রক্তবাহিত রোগ এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ও অন্যান্য রোগ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।

১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।
১৪ জুন দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। এদিন জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের। এই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, ও, এবি’। স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদানকারী আড়ালে থাকা সেসব মানুষের উদ্দেশ্যে, এসব অজানা বীরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ১৪ জুনের বিশ্ব রক্তদান দিবস। শারীরিকভাবে সুস্থ ১৮ থেকে ৫৭ বছর বয়সের মধ্যে কোনো পুরুষ ও নারী রক্ত দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ওজন থাকতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর ওজন অন্তত ৪৫ কেজি। ১২০ দিন পরপর, অর্থাৎ চার মাস পরপর রক্ত দেওয়া যাবে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৫ জন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হয় এবং প্রতি ১০ জনে ১ জন থ্যালাসেমিয়া-বাহক নির্ণীত করা হচ্ছে। কী ভয়াবহ! যেখানে প্রতি ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অন্য রোগীদের অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। রক্ত না দিতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচানো সম্ভব নয়।

রক্তদানে কোনো সমস্যা হয় না। কেননা, একজন মানুষের শরীরে সাড়ে ৪ থেকে ৬ লিটার রক্ত থাকে। রক্তদান করা হয় সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার। এটি শরীরে থাকা মোট রক্তের মাত্র অল্প ভাগ। দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকে। রক্ত সংগ্রহ করা হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। বাকি তিন লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা। বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলো: সচেতনতা, শেয়ার, কেয়ার: থ্যালাসেমিয়া কেয়ার গ্যাপ পূরণে শিক্ষাকে শক্তিশালী করা৷

রক্ত ছাড়া কোনো মানুষের জীবন কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু মানবদেহের এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটির কোনো বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে প্রায়ই জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া রোগী যারা রক্তের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন ঠিক, এদের বেঁচে থাকার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন প্রতি মাসে এক বা একাধিক রক্তের ব্যাগ। থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক বংশগত রক্তের রোগ, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন পর্যাপ্ত হয় না বলেই রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যায়। ফলে এদের দেহে মারাত্মক রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রতি মাসে এক-দুই ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। আর এ কারণেই তাদের বেঁচে থাকাটাই পুরোপুরি নির্ভর করে হৃদয়বান রক্তদাতাদের ওপর। শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগী নয়, কারও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, দুর্ঘটনায় আহত, সন্তান প্রসব, অ্যানিমিয়া, হিমোফিলিয়া, অস্ত্রোপচার, রক্তবমি বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলেও রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে।

নিয়মিত রক্তদান করা একটি ভালো অভ্যাস। রক্তদান করা কোনো দুঃসাহসিক বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কাজ নয়। বরং এর জন্য একটি সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ট। রক্তদাতার শরীরের কোনো ক্ষতি তো হয়ই না, বরং নিয়মিত রক্তদান করলে বেশ কিছু উপকারও পাওয়া যায়। বরং প্রতিবার রক্তদানের পর রক্তদাতার অস্থিমজ্জা নতুন রক্তকণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। ফলে রক্তদানের দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে সে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।

শরীরের রক্তকণিকাগুলোর মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই আপনি যদি রক্তদান না-ও করেন আপনার এই লোহিত রক্তকণিকার ১২০ দিন পর নষ্ট হয়ে শরীরের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যাবে। তাই প্রতি চার মাস পরপর রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি নেই। এতে যেকোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলেও শরীর খুব সহজেই তা পূরণ করা যায়। রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়াল পরজীবীর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। রক্তদাতা রক্তদানের ফলে এই সব টেস্ট সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে করার সুযোগ পাবেন।

রক্তদানে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে এবং রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে যায়। ফলে হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি মারাত্মক রোগের আশঙ্কা হ্রাস পায়। হার্ট ভালো থাকে এবং রক্তদাতা সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকেন। রক্তদানের সময় রক্তে নানা জীবাণুর উপস্থিতি আছে কি না, তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ফলে রক্তদাতা জানতে পারেন তিনি কোনো সংক্রামক রোগে ভুগছেন কি না। রক্তদানে শরীরের ফ্রি রেডিকেলস-এর পরিমাণ কমে যায়। তাই বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেরিতে আসে।

স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানসিক প্রশান্তি আসে। কারণ, প্রতি দুই সেকেন্ডে বিশ্বে এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। আপনার দান করা এক ব্যাগ রক্ত একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয়—সব দৃষ্টিকোণ থেকেই রক্তদাতা অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদাও পান। গ্রহীতা আর তার পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন তার জীবন বাঁচানোর জন্য। দাতার জন্য এটা যে কী আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ থেকে ৯০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন পড়ে। তাদের জীবন ওই সব মহান রক্তদাতার দানের ওপর নির্ভর করে। অনেক গরিব পরিবারের অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য রক্ত কিনতে পারেন না। কোনো কোনো পরিবারে দু-তিনজনও থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছেন। সে জন্য থ্যালাসেমিয়াসহ অন্য রোগীদের জীবন বাঁচাতে রক্তদাতার অবদানকে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আরও রক্তদাতা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়াসহ সবার আরও কাজ করতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পাশে আছে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠানে রক্তদাতারা নির্ভয়ে রক্ত দিতে পারেন।

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির তথ্যানুযায়ী, এই হাসপাতালের নিয়মিত রক্তদাতা ১ হাজারের বেশি এবং  বছরে প্রায় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে থাকে এই হাসপাতাল। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রতিদিন রক্ত প্রয়োজন, যেখানে ৪০-৫০ ব্যাগ সেখানে পাওয়া যায় মাত্র ১১-১২ ব্যাগ অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ রক্তের ঘাটতি থেকে যায়। বাকি রক্ত কাউন্সেলিং, রোড ক্যাম্পেইন ও নানাভাবে জোগাড় করে থাকে। এ হাসপাতাল রক্তদানকারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৫ জন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হয় এবং প্রতি ১০ জনে ১ জন থ্যালাসেমিয়া-বাহক নির্ণীত করা হচ্ছে। কী ভয়াবহ! যেখানে প্রতি ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অন্য রোগীদের অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। রক্ত না দিতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচানো সম্ভব নয়।

এসব রোগী ও তাদের অভিভাবকেরা রক্তের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকেন এক ব্যাগ রক্তের জন্য। আর এই ব্যাগ রক্ত রক্তদাতাদের রক্ত প্রদানের মাধ্যমেই থ্যালাসেমিয়া রোগী না আমি বলব থ্যালাসেমিয়া-যোদ্ধা যারা সারা জীবন রক্ত নিয়েই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। সেই রক্তদাতাদের সাধুবাদ জানাই। ভেবে দেখুন কী ভয়াবহ হারে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিমাণ বাড়ছে, বাড়ছে বাহকের সংখ্যা, বাড়ছে রক্তের চাহিদা আর এ কারণেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে আর এ ক্ষেত্রে বাহক নির্ণায়ক ইলেকট্রোফোরোসিস টেস্ট যদি বিনা মূল্যে প্রতি নতুন রক্তদাতাদের সুযোগ করে দেওয়া যেত, তবে একদিকে রক্তদাতাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত, ঠিক তেমনি থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ অনেকটা সহজ হতো।

থ্যালাসেমিয়াসহ অন্য রোগীদের জীবন বাঁচাতে রক্তদাতাদের বিকল্প নেই। তাই পাশাপাশি আরও রক্তদাতা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমসহ সবার আরও কাজ করতে হবে।

মানুষ হিসেবে মানুষের উচিত অন্যের সেবায় এগিয়ে আসা। আপনার দেওয়া এক ব্যাগ রক্ত যদি একটি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, তবে অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে রক্তদানে এগিয়ে আসা উচিত।

তাই আসুন, আমরা সবাই রক্তদানে অভ্যস্ত হই। অন্তত এক ব্যাগ রক্ত দান করি, সেই থ্যালাসেমিয়া-যোদ্ধাদের জন্য যাঁদের রক্তদানে তারা প্রাণভরে নিশ্বাস নেবে। আপনার এক ব্যাগ রক্ত তাদের বন্ধু, তাদের খাদ্য। আপনার এক ব্যাগ রক্তদানে বাঁচবে হাজারো প্রাণ, বাঁচবে থ্যালাসেমিয়া-যোদ্ধারা। চলুন, নিয়মিত রক্ত দান করি এবং নতুনদের রক্তদানে আগ্রহী করে তুলি।

সৈয়দা বদরুন নেসা
প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল