করোনা কি মাধ্যমিকের জন্য শাপে বর ছিল

কবি তারাপদ রায় লিখেছিলেন ‘আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন’ বুঝতে পারিনি বলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত করোনার সময় আমাদের হলো ঠিক উল্টোটা। আমরা এত দিন মনে করছিলাম, করোনা শিক্ষার সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে তা হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে।

সে বিষয়ে এখন গোটা চারেক গবেষণা সাক্ষ্য দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) দুটি প্রতিবেদন, যেখানে বলা হয়েছে, করোনার সময় অ্যাসাইনমেন্ট অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে; ইউনিসেফ ও এডুকেশন কমিশনের একটি প্রতিবেদন, যেখানে দেখানো হয়েছে, গবেষণাধীন ১০৬টি দেশের মধ্যে মাধ্যমিকে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা নয়, আরও অন্তত ৭৫টি দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে এবং সর্বশেষ বিবিএস ও ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন, যেখানে করোনা যে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাকে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি, তা বলা হয়েছে। এখানে আমরা বিবিএস-ইউনিসেফ প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা করব।

বিবিএস এবং ইউনিসেফ মিলে যে গবেষণা করেছে তার নাম ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেন’স এডুকেশন ২০২১’। এ গবেষণায় তারা তাদের বহু পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে’ (এমআইসিএস) ব্যবহার করেছেন। ২০২১ সালের আগে বিবিএস যেহেতু প্রায় একই পদ্ধতিতে, একই বিষয়ের ওপর ২০১৯ সালে আরেকটি গবেষণা করেছে, ফলে দুটির তুলনা করলেই করোনাজনিত লাভ-ক্ষতির হিসাবটা স্পষ্ট উঠে আসে। যাহোক, এখানে বলা হয়েছে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে করোনার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। নিম্নমাধ্যমিকে এ হার কিছুটা বাড়লেও (৩.৮%, ২০১৯-৫.০%, ২০২১) মাধ্যমিকে তা কমে গেছে (৯.৭%, ২০১৯-৭.১%, ২০২১)। এখানে উল্লেখ্য, মাধ্যমিকে এ ঝরে পড়ার হার গ্রামে আরও বেশি কমেছে (১০.০%, ২০১৯-৭.১%, ২০২১)।

আমরা যদি দেখি, কতজন নিম্নমাধ্যমিক এবং কতজন মাধ্যমিক পর্যায় পার হতে পেরেছে, সে ক্ষেত্রেও করোনার আগের চেয়ে করোনার পরের অবস্থা ভালো। তবে এখানে তুলনামূলকভাবে মাধ্যমিকের (২৯.৪%, ২০১৯-৩২.২%, ২০২১) চেয়ে নিম্নমাধ্যমিক (৬৪.৭%, ২০১৯-৬৯.৪%, ২০২১) ভালো। এখানে উল্লেখ্য, এ দুই স্তরেই ২০১৯-এ গ্রাম ও শহরে যে পার্থক্য ছিল, ২০২১ সালে সেই পার্থক্য নেই বললেই চলে।

করোনার সময় শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্যারেটি ইনডেক্সে তেমন পার্থক্য নেই। নিম্নমাধ্যমিকে এ পার্থক্য কমেছে আর মাধ্যমিকে সামান্য বেড়েছে। মেয়ে ও ছেলেদের ক্ষেত্রে মাধ্যমিকে ও নিম্নমাধ্যমিকে মেয়েরা ভালো অবস্থায় আছে।

ঝরে পড়া নিয়ে আমরা যে খুব শঙ্কিত ছিলাম, তার কারণ, সম্ভবত আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এ গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুল বন্ধ থাকলেও তেমন শিখনঘাটতি হয়নি। ‘গণিত’-এ কিছুটা ঘাটতি দেখা দিলেও ‘পড়া’তে শিক্ষার্থীরা বরং আগের চেয়ে ভালো করেছে। স্কুল ও কোচিং বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা নিশ্চিতভাবেই লেখাপড়ার পেছনে কম সময় ব্যয় করেছে। তারপরও কী কারণে তাদের এত বেশি ক্ষতি হয়নি, সেটা বিশ্লেষণ করতে পারলে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশ করতে পারে। করোনার আগে স্কুল, কোচিং ও বাসা মিলে নিম্নমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে সময় দিত ৬.৯ ঘণ্টা আর করোনার সময় সেটা ছিল মাত্র ২.২ ঘণ্টা। একইভাবে করোনার আগে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে সময় দিত ৭.৫ ঘণ্টা আর করোনার সময় সেটা ছিল মাত্র ২.৬ ঘণ্টা। করোনার সময় পুরো লেখাপড়াটা বাসাতেই হতো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা ছিল স্বশিক্ষা। অর্থাৎ এটা প্রমাণ করে, মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থী স্কুল, কোচিং ও বাসায় ৭.৫ ঘণ্টা লেখাপড়া করে ‘পড়া’ ও ‘গণিত’-এ যা শিখত, করোনার সময় সে বাসায় মাত্র ২.৬ ঘণ্টা পড়ে প্রায় কাছাকাছি মানের শিক্ষা অর্জন করে ফেলেছে।

ফাইল ছবি

যদিও টিভি ও অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল, তারপরও বাসার এ লেখাপড়াকে আমি স্বশিক্ষা বলছি এ কারণে যে এ প্রতিবেদনের উপাত্ত অনুযায়ী, খুব কম বাসাতেই টেলিভিশন (৪৮.৯ %), রেডিও (০.৬ %), কম্পিউটার (৭.০ %) ও ইন্টারনেট (৪৯.০ %) ছিল বা থাকলেও শিক্ষার্থীরা যে তাতে সব সময় ক্লাস করতে পারত, তা নয়। বাসার লেখাপড়াটা স্বশিক্ষায় পরিণত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মূলত স্কুল থেকে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট (৭১.৭%) ও বাড়ির কাজ (২০%)। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৪.২% শিক্ষার্থী স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

তবে মাউশির উপাত্ত অনুযায়ী, অ্যাসাইনমেন্টে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর হার আরও বেশি—৯৩%। যাহোক, অ্যাসাইনমেন্ট যে শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছে, সেটা বেডুর আরেকটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট করে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়েছে, তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে এবং তারা স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এ প্রতিবেদনে ৭২.১% শিক্ষার্থী, ৮৭.৬% অভিভাবক এবং ৯১.৮% শিক্ষক বলছেন, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছে। একইভাবে ৭৮.৮% শিক্ষার্থী, ৮৬.৯% অভিভাবক এবং ৮৪.৬% শিক্ষক বলছেন, অ্যাসাইনমেন্ট করতে দিলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হয়। হয়তো এ কারণেই করোনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়ার অভ্যাস বেড়েছে।

আরও পড়ুন

করোনার সময় শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্যারেটি ইনডেক্সে তেমন পার্থক্য নেই। নিম্নমাধ্যমিকে এ পার্থক্য কমেছে আর মাধ্যমিকে সামান্য বেড়েছে। মেয়ে ও ছেলেদের ক্ষেত্রে মাধ্যমিকে ও নিম্নমাধ্যমিকে মেয়েরা ভালো অবস্থায় আছে।

দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ও শিক্ষার্থীদের শিখন ফল অর্জন অব্যাহত ছিল। অনেকের বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিজিটাল ডিভাইস কিংবা টিভি না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট থাকায় তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয়নি। বিয়ে হয়ে যাওয়া বা কাজে যোগ দেওয়া সব শিক্ষার্থী যে তাদের লেখাপড়া বন্ধ করেনি, এ প্রতিবেদনে এটাও প্রমাণ করে। আমাদের দেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর যে সহজাত ক্ষমতা আছে, তাকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হয়েছে বলে যে সর্বনাশকে অবধারিত মনে হচ্ছিল, তা ঠেকানো গেছে। উপরন্তু করোনাকালীন স্বশিক্ষা ও দূরশিক্ষণ সংস্কৃতির অঙ্কুরোদ্‌গমকে শাপে বর হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক