মেয়রের বক্তব্যে কোনো আশা ও আশ্বাস নেই

বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরীর নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে হাঁটুজলের দুর্ভোগ প্রায় নিয়মিত দৃশ্য

বজ্র ও বৃষ্টিপাতের দিনগুলোয় শত শত ডিঙিনৌকা ভাসে হালদা নদীতে। জলে ও ডাঙায় হাজারো মত্স্যজীবীর আনাগোনায় তখন হালদার তীর থাকে মুখর। ৭ ও ৮ মে সেই চিরাচরিত দৃশ্য দেখা গেল আবার। এই দুদিনও বৃষ্টিপাতের মধ্যে কার্পজাতীয় মা মাছ ডিম ছেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো নমুনা ডিম। বজ্রবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল বাড়লে এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্রে পুরোদমে ডিম ছাড়া শুরু করবে মা মাছ। প্রকৃতির আচরণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে এ বছর প্রচুর ডিম পাওয়ার আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

হালদার তীরে যখন প্রবল বৃষ্টিপাত মানুষের মনে জাগিয়েছে আশা, তখন (৬ মে) মাত্র এক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টি চরম দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছে নগর চট্টগ্রামের মানুষকে। তাপদগ্ধ দুঃসহ দিনের পর এ রকম বৃষ্টি তো প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু এখন বৃষ্টিবিলাসের সামর্থ্য আর নেই, বরং সামনের বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তা ভেবে নগরবাসীর ঘুম হারাম।

গত দেড় যুগে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরীর নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে হাঁটুজলের দুর্ভোগ প্রায় নিয়মিত দৃশ্য। এর সঙ্গে কর্ণফুলীর জোয়ারের সময়টা মিলে গেলে আধুনিক বিপণিবিতান থেকে শুরু করে হাসপাতাল পর্যন্ত চলে যায় কোমরপানিতে। এর মধ্যে ব্যর্থতার দায় নিয়ে বিদায় নিয়েছেন বেশ কয়েকজন সিটি মেয়র। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) শীর্ষ পদেও রদবদল ঘটেছে কয়েকবার। কিন্তু দুর্ভোগের চিত্র বদলায়নি।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে তিনটি সেবা সংস্থা। সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন একটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। ১৪ হাজার কোটি টাকার ৪ প্রকল্পের কাজ ৭ বছরেও শেষ হয়নি। অথচ খরচ হয়ে গেছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। যেটুকু শেষ হয়েছে, তার সাফল্যও প্রশ্নবিদ্ধ।

বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব নিয়ে অনেক কথা আছে। তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার এসেছে। এ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার পর অবশ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে দুই পক্ষ থেকেই। কিন্তু সেটা থেকে গেছে কথার কথাই।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সভা হয় ও কিছু ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। তাতে আর যা-ই হোক, নগরবাসী অন্তত জানতে পারে যে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে নগরের সেবা সংস্থাগুলো সচেতন। কিন্তু এ বছর তা-ও সময়মতো করা হয়নি। সিডিএর চেয়ারম্যান পদে রদবদলের কারণে এই বিলম্ব। অবশেষে বেশ দেরিতে হলেও সমন্বয় সভাটি হলো। কিন্তু নতুন সমন্বয় সভায় পুরোনো কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্ষার সময় বৃষ্টিতে পানি উঠবে। কেউ বলতে পারবে না যে পানি উঠবে না।

মেয়র মহোদয় নিজেই যদি এতটা নিয়তিবাদী হন, বর্ষায় পানি ওঠার ব্যাপারটা এতটাই স্বতঃসিদ্ধ হয় যে তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এই সমস্যা সমাধানে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের দরকারই–বা কী? অবশ্য তিনি বলেছেন, পানি যাতে দ্রুত নেমে যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তখনো প্রশ্ন উঠবে, ব্যবস্থাটা করবে কে? তিনি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো সংস্থার প্রধান কবে নাগাদ বলতে পারবেন যে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়েছে?

সমন্বয় সভায় মেয়র জলবায়ু পরিবর্তন, পাহাড় কাটা, ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ অগভীর খাল ইত্যাদি নানামুখী সমস্যার কথা বলেন। এমনকি সমস্যা সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা-ও বলেন। তবে ইঙ্গিতে এ কথাও জানান যে অন্যান্য সেবা সংস্থা যদি নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে, তাহলে সিটি করপোরেশনের পক্ষে সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। সিডিএর সঙ্গে করপোরেশনের দীর্ঘদিনের বিরোধের মূল কারণ যে এখানেই, মেয়রের এই বক্তব্যে আমরা তা কিছুটা অনুমান করতে পারি।

আমাদের ধারণা, ২০১৭ সালে সিডিএকে জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প (৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা) দেওয়াটাই ছিল সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা বা লোকবল সিডিএর ছিল না। তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ওপর কোনো কারণে বিরাগভাজন হয়ে নীতিনির্ধারক মহল এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে কথা চালু আছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘আগে সিটি করপোরেশন না সিডিএ কে কাজ করছে, তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি ছিল। আমাদের মধ্যে সেটি নেই। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কত প্রকল্প আনতে পারি, সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।’ এ ধরনের সমন্বয় ও সম্প্রীতির সুর শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু প্রকল্প আনার তোড়জোড়ের আগে বাস্তবায়নের সামর্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাব সিডিএর নতুন চেয়ারম্যানকে।

আমাদের ধারণা, ২০১৭ সালে সিডিএকে জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প (৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা) দেওয়াটাই ছিল সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা বা লোকবল সিডিএর ছিল না।

তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ওপর কোনো কারণে বিরাগভাজন হয়ে নীতিনির্ধারক মহল এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে কথা চালু আছে। এ-ও শোনা যায় যে ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যানের ওপর ভিত্তি করে অগোছালো একটি প্রকল্প জমা দিয়ে বরাদ্দ পেয়েছিল সিডিএ। সেই থেকে সিটি করপোরেশন ও সিডিএর টানাপোড়েন চলছে, যার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

আরও পড়ুন

শেষ সমন্বয় সভাটিতে মেয়রের বক্তব্যে মূলত দুর্ভোগের পূর্বাভাসই দেওয়া হয়েছে, সেখানে নগরবাসীর জন্য নেই কোনো আশার কথা। খোদ মেয়রই যখন এমন অসহায় (তাঁর বহদ্দারহাটস্থ বাড়িতেও পানি ওঠে), সেখানে নগরবাসীর ভবিতব্য সহজেই অনুমেয়। গত বর্ষায় ১৩ বার ডুবেছিল নগর। এত হাঁকডাক, এত অর্থ ব্যয়ের পর এবারও সেই গোনাগুনতির দিন আসছে। 

বিশ্বজিৎ চৌধুরীপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক