শিশুদের মারধর চলছে! চলবেই কি

ফাইয়াজ মির্জাকে আমি সেদিন আশা করিনি অফিসে। ৩০ এপ্রিল শিশুদের মারধর বন্ধের দিন, সেই দিনেই ছিল তার শেষ পরীক্ষা। মানে এবারের মতো শেষ। পরীক্ষা তাদের সারা বছরেই চলে। এবার পরীক্ষা শেষে নানা-নানির সঙ্গে দেশের বাড়ি যাবে। তাই একটু বেশিই হাসিখুশি ছিল ফাইয়াজ। এখন ফাইয়াজ পঞ্চম শ্রেণিতে। যখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছিল, তখন শেষ মুখোমুখি দেখা হয়েছিল। বলতে গেলে অনেক দিন পর দেখা। নানির ফেসবুকে তাকে দেখি মাঝেমধ্যে ছাদবাগানের গাছের সেবাশুশ্রূষায় মগ্ন।

গাছ, টব, ফুল, পাখি—এসব নিয়ে আলোচনা হতে হতে আমাদের আলোচনা কীভাবে যেন স্কুলে চলে গেল। শিশুরা কোথাও বেড়াতে গেলে পড়াশোনা, বই–খাতা, পরীক্ষা—এসব নিয়ে উপদেশমাখা আলোচনা পছন্দ করে না। এটা জানা ও গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে অনুশীলনের পরও কেন যে আমাদের আলোচনা স্কুলে ঢুকে গেল! হতে পারে ৩০ এপ্রিলের আসর। পত্রপত্রিকা বা চ্যানেল টিভি অথবা অনলাইন মিডিয়ায় যাঁরা শিশু বিট দেখেন, তাঁরা সবাই কমবেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের মারধর বন্ধের বিষয়ে আওয়াজ তুলেছেন। ফাইয়াজ আসার আগে সেগুলোতে চোখ ছিল, তাই তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসি, তোমাদের স্কুলে কি মারে?

অহিংস শৈশব শিশুর অধিকার। শিশু যদি অহিংস শৈশব পায়, তাহলেই কেবল একটা বৈষম্যমুক্ত সমাজ আর শান্তির দেশ গড়ে তোলা সম্ভব

ফাইয়াজ ঢাকার খুব নামকরা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়ে। ঢাকার উত্তর–দক্ষিণ মিলিয়ে তাদের গোটা চারেক শাখা। স্কুলের নামটা এখানে ছেপে দিলে ভালো হতো, কিন্তু তাতে কি মির্জার ভালো হতো? স্কুল কর্তৃপক্ষ কি ছেলেটির সত্য কথা সহ্য করে নিজেদের শুধরে নিত? আবার আমি বুক ফুলিয়ে স্কুলের নাম লিখে দিলেই যে সেটা ছাপা হবে, তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? মাদ্রাসা হলে হয়তো সহজ হতো; কিন্তু এটা তো একটা আস্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ধরা যাক স্কুলের নাম ‘বিধাতার মন’ বা ‘পথের দিশা’ কিংবা ‘সবুজের দিশারি’। এসব স্কুলের নামগুলো কিন্তু ভারি চমৎকার।

ফাইয়াজ মির্জা প্রথমে গ্যা–গু করলেও পরে তার অর্গল খুলে যায়। মনে হচ্ছিল, এ কথাগুলো সে কাউকে বলার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল। গল গল করে বলতে থাকে ক্লাসে, স্কুলে তাদের নিগ্রহের কথা। বলে দিল তাদের স্কুলেও মার চলে। বাড়িতে সে কথা সে কোনো দিন বলেনি। কেন বলেনি? মারপটু শিক্ষকেরা বলে দিয়েছেন ‘মারধর হচ্ছে আশীর্বাদ’। এসব আশীর্বাদের কথা কাউকে বলতে নেই, আশীর্বাদের মেওয়া বড় হলে বুঝবে।

মনে পড়ল ২০২৪ সালের ১৪ মের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় এক স্কুলের প্রধান মারধরের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন ‘…তাকে (শিক্ষার্থীকে) আমার ছেলে মনে করে শাসন করেছি, চড়-থাপ্পড় মেরেছি। আমি তাকে মারধর করতেই পারি, শাসন করতে পারি। বিষয়টা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। এটাকে কি সহজভাবে দেখা যায় না?’ সমঝোতার পর আবার কী কথা?

ফাইয়াজ মির্জার কাছে জানতে চাই, কী দিয়ে মারে? বলে, হাত দিয়ে, লাঠি দিয়ে। কোথায় মারে? হাত দিয়ে দেখাল, কানের পেছনে। কানের পেছন, যাকে চলতি বাংলায় বলে ‘কানসাটটা’। এটা শরীরের খুবই স্পর্শকাতর জায়গা। একজন চিকিৎসক জানালেন, ‘কানের পর্দা এবং মধ্য ও অন্তঃকর্ণের মতো সূক্ষ্ম কাঠামোর কাছাকাছি থাকার কারণে কানের পেছনের অংশটি খুবই সংবেদনশীল। কানে একটি থাপ্পড়, বিশেষ করে জোরে, ব্যথার কারণ হতে পারে এবং কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

আর লাঠি দিয়ে কোথায় মারে? ফাইয়াজ মির্জার ডান হাতটা পিঠে চলে গেল। দেখাল, পিঠে পরপর দুটি বাড়ি দেয়। একটা নয় দুটি কেন? ফাইয়াজ বলে, দ্বিতীয়টা রিপিট। এ কথার কোনো মানে বুঝলাম না। তবে আমাদের স্কুলের এক স্যারের কথা মনে পড়ল, তিনি কিল মারতেন পিঠে ঠিক এক জায়গায় গুনে গুনে দুইবার। এটা ফাইয়াজকে জানাতেই সে বলে, ‘ওনারা বোধ হয় একই স্কুলে পড়েছেন।’ ফাইয়াজের সেন্স অব হিউমার বা রসবোধে আমি হাসি। তবে এটা স্রেফ রসবোধ নয়, ফাইয়াজের কথার মধ্যে বিজ্ঞান আছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব শিশু মারধরের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময় তাদের মধ্যে আগ্রাসন, অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক আচরণের আধিক্য দেখা দেয়। তবে কি কথিত ইংরেজিমাধ্যমের শিক্ষকেরা শিশুকালে মারধরের ঘেরাটোপে বেড়ে উঠেছেন? তাহলে তো নির্দেশনা আর পরিপত্রে কাজ হবে না। তাঁদের লম্বা কাউন্সেলিং দরকার। হয়তো কারও কারও ক্লিনিক্যাল কাউন্সেলিং লাগবে। শরীরের বিশেষ স্থান লক্ষ্য করে নিয়মিত হাত চালানোকে মানসিক ব্যাধিই বলতে হবে।

ফাইয়াজ মির্জা থামে না। শাস্তির ধরন নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিতে থাকে—চুল ধরে টানা, দুই আঙুলের মধ্যে পেনসিল দিয়ে চাপ দেওয়া, গালি দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলি, বাংলায় কোনো গালি নাই। ফাইয়াজ বলে, কেন ‘বেয়াদপ’তো বাংলা। তারপর শুধরে নেয়, না না ওটা তো উর্দু, তাই না! ফার্সিও হতে পারে। তবে বাংলা নয়, সেটা শিওর। গাধাও বলে। ফাইয়াজ বলে গাধার চেয়ে বেয়াদপ সহনীয়। ইংরাজিতেও খুব বিশ্রি একটা গালি দেয়। শব্দটা ইংরেজি অক্ষর ‘বি’ দিয়ে শুরু। ফাইয়াজের চোখ টলমল করে ওঠে। আমরা বিস্কুট খাই। ফাইয়াজ চলে যায়। সঙ্গে থাকা ওর নানা বুঝতে পারেন না, এত কষ্ট বুকে চেপে রেখে ফাইয়াজ কীভাবে দিন যাপন করছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের সময় প্রায়ই অন্য শিক্ষার্থীদের অংশীদার করা হয়। মারার সময় যাতে শিক্ষার্থী নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে না পারে, তাই অন্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে তার হাত–পা ধরে রাখা, তথাকথিত মনিটর বা ক্যাপ্টেনকে দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়।এ ধরনের শাস্তি শিশুর মানবিক মর্যাদাকে গভীরভাবে ক্ষুণ্ন করে। নিঃসন্দেহে এটা শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করে সরকার পরিপত্র জারি করেছে ২০১১ সালে। এ ধরনের মারধরকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। তারপরও শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমান গালিগালাজ বন্ধ হয়নি। অনেকেই এখন শক্ত আইন প্রণয়নের কথা বলছেন। তাতে শিশুরা কতটা নিরাপদ হবে বলা মুশকিল। শিশুদের মারধর করার ‘সামাজিকভাবে স্বীকৃত’ একটি আচরণ। অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘মারের ওপর ওষুধ নাই।’ শিশুকালের মারটায় তাদের ‘আশীর্বাদ’ ছিল। মারের পথ ধরেই তাদের বিকাশ ঘটেছে।

যে জনপদে একসময় বিধবা নারীদের পুড়িয়ে মারাটা ধর্মের কাজ মনে করা হতো, সেই জনপদে শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন অসহায় শিশুদের মুক্তি সহজে মিলবে কি?

তবু আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এমন এক মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছি, যেখানে শিশুদের প্রতি কোনো ধরনের সহিংসতা থাকবে না।আমাদের বুঝতে হবে, এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাতেই শাস্তির কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। শাস্তি শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামগ্রিক বিকাশের ওপর কেবলই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শৈশবের এই দৈনন্দিন সহিংসতা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আক্রমণাত্মক মনোভাব,অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক আচরণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। শারীরিক শাস্তি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখে।

অহিংস শৈশব শিশুর অধিকার। শিশু যদি অহিংস শৈশব পায়, তাহলেই কেবল একটা বৈষম্যমুক্ত সমাজ আর শান্তির দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক

[email protected]