ভাষা শুধু আবেগের নয়, অর্থনৈতিক ব্যাপারও

ভাষাবিজ্ঞানী ও গবেষক শিশির ভট্টাচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ব্যাকরণচর্চা নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলা ভাষার বর্তমান সংকট, ভাষার উৎকর্ষের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রের করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

শিশির ভট্টাচার্য্য

প্রশ্ন :

বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শিশির ভট্টাচার্য্য: সাংবিধানিকভাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এটা আইনগত, কিন্তু কার্যত নয়। আদালতের রায় দেওয়ার সময়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার হয় না। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিসন্দর্ভগুলো ইংরেজিতে লিখতে উৎসাহ দেওয়া হয়। এভাবে দেখলে বাংলা ভাষা আমাদের দেশে ইংরেজির তুলনায় পিছিয়ে আছে। ইংরেজি আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অংশ। আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি আমরা অবশ্যই শিখব, কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে তা হওয়ার কথা ছিল না। কোনো ভাষা শেখার জন্য সেই ভাষাটিকে শিক্ষার মাধ্যম করা অপরিহার্য নয়। ভাষা শুধু আবেগের ব্যাপার নয়। ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির প্রশ্ন জড়িত। একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করে শতভাগ মানুষ শিক্ষিত হওয়ার নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। আমরা সেই টেকসই উন্নয়ন করতে পারছি না।

প্রশ্ন :

সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায়?

শিশির ভট্টাচার্য্য: ইংরেজিকে আমাদের দাপ্তরিক ভাষা করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষার জোগান (ইনপুট) নেই। এমনকি প্রমিত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ সুযোগ সীমাবদ্ধ। আমাদের ভাষার জোগান আঞ্চলিক ভাষার। এভাবে ভালো ইংরেজি শেখা সম্ভব নয় সব শিক্ষার্থীর পক্ষে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি যাঁরা পড়াচ্ছেন, সেই শিক্ষকদের নিজেদের ইংরেজি মানসম্মত নয়। কারণ, তাঁরা নিজেরাই ভাষাটা ভালোভাবে শেখার সুযোগ পাননি। লাখ লাখ চীনা বা জাপানিকে বহু অর্থ খরচ করে যেমন ইংরেজিভাষী করে তোলা যায়নি, তেমনি গড় বাঙালিকে আপনি ইংরেজিভাষী করে তুলতে পারবেন না। শিক্ষার বিস্তার চাইলে বাংলার ওপরেই নির্ভর করতে হবে।

প্রশ্ন :

আদালতের রায় ইংরেজিতে দেওয়া প্রসঙ্গটি আপনি উল্লেখ করলেন। বাংলায় দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না সব সময়?

শিশির ভট্টাচার্য্য: এমন নয় যে আমাদের বিচারকেরা সবাই বাংলা জানেন না। কিন্তু অনেক আইন এখনো বাংলা করা হয়নি। ভাষান্তরের ইচ্ছাও পোষণ করা হয় না।  একটা কথা আছে, ভিনদেশি ভাষায় বিচার করা মানে আদতে বিচারকে অস্বীকার করা। সুতরাং আদালত ভিন্ন ভাষায় রায় দিলে সেটা ন্যায়বিচার করা হচ্ছে বলা চলে না। কারণ, বাদী আর বিবাদী বুঝতেই পারছেন না কী নিয়ে কথা হচ্ছে। শুধু উকিল আর বিচারক বুঝতে পারছেন। উন্নত দেশগুলোয় এমন কখনো সম্ভব নয়। বাদী অথবা বিবাদী যদি বলেন যে তিনি ফরাসি ভাষায় বিচারপ্রক্রিয়া জানতে চান, তাহলে আদালত সে ব্যবস্থা করতে বাধ্য।

প্রশ্ন :

তার মানে পুরোদমে বাংলায় রায় দেওয়ার ব্যবস্থাটাই এখনো তৈরি হয়নি?

শিশির ভট্টাচার্য্য: ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে বিধান আছে ‘যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সব আইন বাংলা হয়নি। পদ্মা সেতু হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, আমাদের যে টাকা নেই, তা নয়। তাহলে ভাষার ক্ষেত্রে কেন বছরজুড়ে মনোযোগ থাকবে না? উদ্যোগগুলো নিলে তো অনুবাদকদের জন্যও কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়।

প্রশ্ন :

এ কাজের জন্য বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ভূমিকা রাখছে?

শিশির ভট্টাচার্য্য: অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না সম্ভবত অনাবশ্যক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসানো হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। কাজ হয় না, কেননা কর্তারা কাজ করতে চায় না। কিংবা যার যা কাজ তাকে তা করতে দেওয়া হয় না। যেমন ধরুন, বাংলা একাডেমির কাজ কি বইমেলা আয়োজন করা? এ কাজ তো প্রকাশক সমিতিই করতে পারে।

প্রশ্ন :

তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরজুড়ে কী করে?

শিশির ভট্টাচার্য্য: অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সরকারি। আমাদের দেশে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমলারা এসব প্রতিষ্ঠানে নজরদারি করেন। নিজেদের আসল কাজ বাদ দিয়ে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষা মেলা করছে, বাংলা একডেমি বইমেলা করছে, পোস্টার-ব্যানার লাগাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমশক্তি ব্যয় হচ্ছে এসব অনুষ্ঠানে। তাদের দায়িত্ব ভাষা নিয়ে কাজ করা। যেমন বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যত ভাষা আছে, সেগুলোর ব্যাকরণ এবং অভিধান তৈরি করতে হবে। বিদেশি সাহিত্যের ভালো বাংলা অনুবাদ হতে হবে। উন্নত অভিধান বানাতে হবে এবং কাজগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন :

বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, পালি, আরবি বিভাগের মতো কয়েকটি ভাষা শেখার বিভাগ আছে। অনেক মূল্যবান সংস্কৃত পুঁথি আছে মহাফেজখানাগুলোয়। অথচ বাংলায় অনুবাদ হয় না।

শিশির ভট্টাচার্য্য: মেধাতালিকায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা গিয়ে সংস্কৃত, আরবি, পালি বা ফারসিতে পড়ার সুযোগ পায়। কোন বিষয়ের শিক্ষার্থী সেটা বলতেও যেন লজ্জা পায় শিক্ষার্থীরা। সংস্কৃত বা ফারসি পড়ার ইচ্ছা যার আছে, তাদেরই এসব ভাষা বিভাগে ভর্তি হওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ রাখা হয়নি।

ফলে এত সংকোচের ভেতর শিক্ষার্থীটি অন্য ভাষা থেকে মাতৃভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে কেমন করে অবদান রাখবে? এখন সংস্কৃত বা আরবি বাংলায় পড়ে শিক্ষার্থীরা। ওই বিষয়ের গবেষণা প্রবন্ধ লেখা হয় বাংলায়। তারা তো আসলে শিখছেন না ভাষাটা। তবে অন্য ভাষা অবশ্যই পড়তে হবে আমাদের, কেননা ঐতিহ্যগত যোগাযোগ রয়েছে ভাষার সঙ্গে ভাষার।

বিভাগের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা প্রাচ্য ভাষা ইনস্টিটিউট হতে পারে। সেখানে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ভর্তি না করে অল্প শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভালোভাবে পাঠদান করানো যেতে পারে।

প্রশ্ন :

ভাষার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কটা কী?

শিশির ভট্টাচার্য্য: ভাষা প্রয়োগ দুর্বল হলে শিক্ষাও দুর্বল হবে। সঠিকভাবে শিক্ষিত না হতে পারলে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে যেতে হয়। সেই জায়গা দখল করে ভারত বা পাকিস্তান থেকে আসা অন্য কোনো চৌকস ছেলেমেয়ে। অথচ ওই সুযোগ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের পাওয়ার কথা ছিল।

এদিকে কর্মসংস্থানের অভাবে হাজার হাজার তরুণ ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিদেশে চলে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করছে। আরেক দল তরুণ যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা নিতে। এদের অধিকাংশ আর ফিরে আসে না। তারা যা শিখেছে, তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে না। অথচ প্রতিবছর প্রায় একটা পদ্মা সেতু তৈরির সমান টাকা যায় দেশের বাইরে পড়া ছাত্রদের শিক্ষার খরচ খাতে। টাকাটা কোথায় যাচ্ছে?

আগে রবার্ট ক্লাইভ এসে চুরি করে নিয়ে যেত, এখন আমরাই নিজেদের সম্পদ চুরি করে নিয়ে গিয়ে ক্লাইভদের দেশে জমা করে দিচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের প্রবাসীদের কষ্ট করে পাঠানো টাকা আবার পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। একে স্বশোষণ বা নব্য উপনিবেশবাদ বলা যায়। এ সবকিছুর সঙ্গে শিক্ষা ও ভাষা জড়িত।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষাচর্চার অন্তরায় কী?

শিশির ভট্টাচার্য্য: বাংলাদেশে অন্যান্য জাতিসত্তার বেশ কিছু ভাষা আছে। সেগুলো বাংলা হওয়া দরকার। ভাষাগুলোর লিপি ও ব্যাকরণ জানা দরকার। এই কাজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের করার কথা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে না জানা অপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন :

ভাষাদূষণ কতটা ক্ষতি করছে বাংলা ভাষার?

শিশির ভট্টাচার্য্য: ভাষাদূষণ নামে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। দ্বিভাষী ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিদেশি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করবে, এটাই স্বাভাবিক। মধ্যযুগে আরবি, ফারসি শব্দ বাংলা শব্দকোষে ঢুকেছে। ইদানীং ইংরেজি শব্দ ঢুকছে। অন্য ভাষার শব্দ প্রবেশ বন্ধ করা কার্যত অসম্ভব। এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে বাংলা ইংরেজি পড়া এবং লেখার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন :

সেই জোর কীভাবে দেওয়া সম্ভব?

শিশির ভট্টাচার্য্য: জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যঁারা পড়াবেন, আগে তাঁদের তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষকই ভবিষ্যতের সব পেশার কর্মজীবী তৈরি করেন। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় আগে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার চালু করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রসংখ্যা কমাতে হবে কিংবা শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভালো হতো যদি সুইডেন, নরওয়ে বা ডেনমার্কের মতো সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের উচ্চ বেতনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া যেত। রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ বেতনটা শিক্ষকদের দেওয়া হলে সেরা ছাত্ররা এই পেশায় আসতে আগ্রহী হতেন। দশক দুয়েক ধরে এটা করা গেলে অনেক কিছু বদলে যেত বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন :

আপনাকে ধন্যবাদ।

শিশির ভট্টাচার্য্য: আপনাকেও ধন্যবাদ।