হর্ন বাজালে কি সবার আগে যাওয়া যায়?

মাঝেমধ্যে শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে দু-একজন মানুষ প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। ব্যতিক্রমী সেসব উদ্যোগে কান ও মনের বধিরতা ভেঙে একেবারেই প্রভাব ফেলতে পারে না।
ছবি : সংগৃহীত

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। সাপ্তাহিক ছুটি শুরুর আগে ঘরে ফেরা মানুষের তাড়া। কারওয়ান বাজার থেকে সিএনজি অটোরিকশায় উঠেছি। মেট্রোরেলস্টেশনের নির্মাণকাজ চলায় সড়ক এখানে এমনিতে সরু। সিগন্যালে অনেকটা সময় আটকে থাকতে হচ্ছে।

একসময় সিগন্যাল ছাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল, বাস, প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, সিএনজি—সব গাড়ির চালকেরা একযোগে হর্ন বাজাতে শুরু করলেন। কে কাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারেন, যেন সেই প্রতিযোগিতা সবার মধ্যে। একটা জায়গায় এভাবে শত শত গাড়ি থেকে একযোগে হর্ন বাজালে পরিস্থিতি কতটা আতঙ্ক-জাগানিয়া হতে পারে, তা আমরা নগরবাসী সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। একটা গাড়ির সঙ্গে আরেক গাড়ির ব্যবধান যেখানে এক ইঞ্চিরও ভগ্নাংশমাত্র, সেখানে সুপারম্যানের মতো উড়ে যাওয়া ছাড়া আগে যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এভাবে বেপরোয়াভাবে হর্ন বাজানোর অর্থ কী?

এ তো গেল সড়ক। ঢাকার ভাঙাচোরা ফুটপাত ধরে কসরত করে হাঁটতে গেলে পেছন থেকে একেবারে গায়ের ওপর উঠে পড়া মোটরসাইকেলের আচমকা হর্ন শুনে চমকে ওঠেননি, এমন পথচারী খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। আর ফুটপাতহীন অলিগলির সড়কগুলো সাক্ষাৎ ‘সবাই রাজার দেশ’। সেখানে গাড়ি আর মোটরসাইকেলের উপর্যুপরি হর্ন আর রিকশার বেলের শব্দে পথচারীদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়। ধৈর্য হারিয়ে আপনি যদি কোনো চালককে প্রশ্ন করে বসেন, এভাবে হর্ন বাজাচ্ছেন কেন? নিশ্চিতভাবেই ধরে নিন একটা তর্কযুদ্ধের মঞ্চ হয়ে উঠবে আপনার প্রশ্নটি। অপর পক্ষে যদি দুই বা তার অধিক আরোহী থাকেন, তাহলে আপনার প্রশ্নটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সর্বনিম্ন শাস্তি গালমন্দ-হুমকি-ধমকি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আপনার পিঠে কিল-ঘুষি পর্যন্ত জুটতে পারে।

রাইড শেয়ারিংয়ের কোনো মোটরসাইকেল কিংবা গাড়িতে চড়লে কৌতূহলবশত মাঝেমধ্যে জিজ্ঞাসা করি, কেন তাঁরা এত বেপরোয়াভাবে হর্ন বাজান? এ প্রশ্নে দুধরনের উত্তর পাওয়া যায়। একদল বলেন, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আঙুল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হর্নের সুইচে চাপ দিয়ে বসেন। ফাঁকা রাস্তায়ও তঁারা হর্ন বাজিয়ে বসেন। আরেক দল আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি দেন, রাস্তায় এত এত মানুষ আর তঁারা এমন নির্বিকারভাবে চলেন যে হর্ন না বাজালে যে–কেউই গাড়ির সামনে এসে পড়তে পারেন।

অযথা বা উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারায় বলা আছে, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। মজার বিষয় হচ্ছে, এই আইন বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ফলে আইন থাকলেও উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজানোর কারণে কারও শাস্তি হয়েছে, এমনটা শোনা যায় না। আইন করে যদি তার প্রয়োগ না হয়, তাহলে আইন করার অর্থ কী?

বাংলাদেশের নগরগুলোতে শব্দদূষণের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবাদমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটু মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়লে যে কারোরই আঁতকে ওঠার কথা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিশ্বে শব্দদূষণে শীর্ষ নগর ঢাকা। ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় গড় শব্দের মাত্রা তারা পেয়েছে ১১৯ ডেসিবেল। অথচ মানুষের সুস্থ থাকার জন্য সহনীয় মাত্রা ঠিক এর অর্ধেক। কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে উঠে এসেছিল, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে বাংলাদেশের ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। তারা সতর্ক করেছিল, ২০২৩ সাল নাগাদ দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন।

উচ্চ শব্দের কারণে বধিরতায় আক্রান্ত কত শতাংশ মানুষ, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, এ ক্ষেত্রে আমাদের মানসিক বধিরতা প্রায় শতভাগ। আমরা তো নিজেদের কৃতকর্মের জন্য বধির হচ্ছিই, সন্তানদেরও বধির বানাতে পিছু হটছি না। তিন-চার বছরের একটি শিশুকে মোটরসাইকেলের সামনে বসিয়ে যে অভিভাবক হর্ন বাজাতে বাজাতে চলেন, তিনি কি কখনো ভেবে দেখেন, এতে তাঁর সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব পড়ে।

কোনো কিছু যখন আমরা দেখতে থাকি, একসময় সেটাকে স্বাভাবিক বলে ভাবতে শুরু করি। হর্ন বাজানো এখন আমাদের স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ জন্য হর্ন না বাজিয়ে কেউ গাড়ি চালালে সে ঘটনা পত্রিকার পাতায় খবর হয়। শব্দদূষণের ক্ষতি নিয়ে আমরা নাগরিকেরা পুরোপুরি উদাসীন। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এ নিয়ে একেবারেই ভাবেন না। বেসরকারি পর্যায়েও শব্দদূষণ বন্ধে সচেতনতা তৈরিতে উদ্যোগ নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে দু-একজন মানুষ প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। ব্যতিক্রমী সেসব উদ্যোগে কান ও মনের বধিরতা ভেঙে একেবারেই প্রভাব ফেলতে পারে না।

সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত একজন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, তাঁর দেশে রাস্তায় চলতে গেলে গরুর গলার ঘণ্টা শোনা যায়, আর বাংলাদেশের রাস্তায় শোনা যায় গাড়ির হর্ন। আসলে হর্ন না বাজিয়েও যে গাড়ি চালানো যায়, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই আমাদের নেই। একটা সমাজ কার্যকরভাবে টিকে থাকার জন্য প্রাতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে হয়। আইনসভা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন—এসব আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আচার-আচরণ, প্রথা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা—এসব অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই স্বাধীনতার সীমা আছে। অন্য নাগরিকের সমস্যায় পড়েন, এমন কোনো কাজ নাগরিকের স্বাধীনতার সীমার মধ্যে পড়ে না। অযথা উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো যে স্বাভাবিক আচরণ নয়, সেটা কি আমরা বুঝতে পারি?

অযথা বা উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারায় বলা আছে, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। মজার বিষয় হচ্ছে, এই আইন
বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ফলে আইন থাকলেও উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজানোর কারণে কারও শাস্তি হয়েছে, এমনটা শোনা যায় না। আইন করে যদি তার প্রয়োগ না হয়, তাহলে আইন করার অর্থ কী?


মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

[email protected]