ইসলামে প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিধান
জীববৈচিত্র্য মহান আল্লাহর দান, সৃষ্টি কুদরতের নিদর্শন এবং মানবজাতির প্রতি করুণা। কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং তাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৯)
‘তাঁর নিদর্শনাবলির অন্যতম হলো আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং এদের মধ্যে বিস্তৃত জীবজন্তুর সৃষ্টি। নিশ্চয়ই তিনি চাইলে সেসব একত্র করতে সক্ষম।’ (সুরা-৪২ শুরা, আয়াত: ২৯)
‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করে বিছিয়ে দিয়েছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং সব বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। তাতে ব্যবস্থা করে দিয়েছি তোমাদের জীবিকার এবং তাদের জীবিকারও, যাদের রিজিকদাতা তোমরা নও। এমন কোনো জিনিস নেই, যার ভান্ডার আমার কাছে রক্ষিত নেই। আমি তা প্রয়োজন অনুসারেই প্রদান করি। আর আমি বৃষ্টিসঞ্চারী বায়ু প্রেরণ করি, তারপর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই। অথচ তোমরা তো সেই ভান্ডারের মালিক নও।’ (সুরা-১৫ হিজর, আয়াত: ১৯-২২)
মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির জন্য জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমি আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি। অতঃপর তা দ্বারা উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বিপুল বৃক্ষরাজির নিবিড় বন, ফলফলাদি ও ঘাস—তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর জীবনধারণের সামগ্রী।’ (সুরা-৮০ আবাসা, আয়াত: ২৪-৩২)
মানবসভ্যতা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা। আর এ জন্য জীববৈচিত্র্য তথা প্রাণিকুল ও উদ্ভিদজগৎ রক্ষা করা জরুরি। তাই প্রকৃতি
ও পরিবেশকে মানবসৃষ্ট কৃত্রিমতা এবং এর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও মাটিদূষণ বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতিকে তার আসল চরিত্র ও নিজস্ব গতিতে সচল রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জলে-স্থলে সব বিপদ মানুষের হাতের
কামাই। যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের কুফল কিছুটা ভোগ করে এবং তা থেকে ফিরে আসে।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ৪১)
‘কেউ যদি চড়ুই পাখি বা তার চেয়ে ছোট কোনো প্রাণীকেও অকারণে হত্যা করে, কিয়ামতের দিন তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রধানত জলবায়ু, খাল-বিল, নদী–নালা, গাছপালা, তরু–লতা, জীবজন্তু ও পশুপাখির যথাযথ সংরক্ষণ করা দরকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কারও হাতে রোপণ করার জন্য কোনো চারা থাকে, এমতাবস্থায় কিয়ামত এসে যায় এবং রোপণ করার সময়ও পাওয়া যায়, তাহলে সে যেন রোপণ না করে দাঁড়িয়ে না থাকে।’ (উমদাতুল কারী শারহে বুখারি: ১২/১৫৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়-জুলুম না করে কোনো কিছু নির্মাণ করে অথবা কোনো চারা রোপণ করে, যত দিন আল্লাহর সৃষ্টি তা থেকে উপকৃত হবে, তত দিন রোপণকারী তার সওয়াব পেতে থাকবে।’ (উমদাতুল কারী শারহে বুখারি: ১২/১৫৫)
উদ্ভিদের মাধ্যমে আবহাওয়া, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাণিজগৎ সুরক্ষিত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রেও তোমরা কোনো খেজুরগাছ বা অন্যান্য উদ্ভিদ কর্তন কোরো না।’ (ইরশাদুল ফকীহ্: ২/৩২০)
জলবায়ু পরিবর্তন, আবহাওয়ার চরম বৈরিতা ও পানিদূষণ রোধে রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক নির্দেশনা দিয়েছেন। পানির অপচয় রোধে এবং পানিতে আবর্জনা ও বর্জ্য ত্যাগ পরিহারের বিষয়ে নবী কারিম (সা.) বিশেষভাবে সাবধান করেছেন। একদা হজরত সাআদ (রা.) অজুতে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, ‘সাআদ! পানির অপচয় করছ কেন?’ তিনি বললেন, ‘অজু করার ক্ষেত্রেও কি অপচয় হয়?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘অবশ্যই! এমনকি তুমি যদি বহমান নদী বা সাগরের তীরে বসেও অজু করো, তাহলেও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার অপচয় হিসেবে গণ্য হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুই অভিশপ্ত লোক থেকে দূরে থাকো।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তারা কারা?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের চলাচলের পথে মলমূত্র ত্যাগ করে এবং যে ব্যক্তি মানুষের ছায়া গ্রহণস্থলে পায়খানা-প্রস্রাব করে।’ (সহিহ্ মুসলিম: ১৮৮)
রাসুলুল আকরাম (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি চড়ুই পাখি বা তার চেয়ে ছোট কোনো প্রাণীকেও অকারণে হত্যা করে, কিয়ামতের দিন তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ (মিরকাত শরহে মিশকাত: ২৬৫৮)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। ই–মেইল: [email protected]