বিএনপির পশ্চাৎপদ রাজনীতি দিয়ে কি রাষ্ট্র মেরামত সম্ভব?

রাজধানীর একটি হোটেলে গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ তুলে ধরেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন
ছবি: সাজিদ হোসেন

২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে বিএনপি তথাকথিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত’-এর উদ্দেশ্যে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে। এ রকম দাবি-দফা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ। আগেও দলটি বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিল। বিশ্লেষকেরা লিখছেন, ‘ভিশন ২০৩০’ আলোকে এবার ২৭ দফা প্রণীত হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্নীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের পক্ষে ঘোষিত ২৭ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কতটা সম্ভব? ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা যাক।

দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রচারিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তাদের রাজনীতি আবর্তিত হয়। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বদলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদের রক্ত মিশে গেছে—সেখানে ছিল না ধর্মের ভেদ, ছিল না বর্ণের ভেদ। এ জন্য বাহাত্তরের আদি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

অবশেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা আবার সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাহাত্তরে গণপরিষদ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। অন্যদিকে সংবিধানে সংশোধনে আনা বিএনপি যখন বলে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’, তখন তা বেশ কৌতুকপ্রদ মনে হয়। ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল।

তা ছাড়া ২০১৩ সালে হেফাজত যখন ১৩ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল, তার একটি দফা ছিল সংবিধানের চার মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দেওয়া। তখন বিএনপি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কেবল একাত্মতা ঘোষণা করেনি, হেফাজতের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে সচেষ্ট ছিল। সেই বিএনপি কী করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বে?

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদের সামরিক সরকারের যাবতীয় অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার কার্যক্রম থেকে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে একদিক থেকে যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংবিধান বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হয়, একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপেক্ষিত করার এক সাংবিধানিক প্রয়াস লক্ষ করা যায়।

আরও কিছু দফা নিয়ে আলোচনা করা যাক। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, বিএনপি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু আমরা একটু পেছনে তাকালেই দেখতে পাই, বিএনপির শাসনামলে প্রতিহিংসার রাজনীতির যে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়, তা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য লজ্জাজনক। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্যমে তৎকালীন বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার যে প্রচেষ্টা করা হয়েছে দলটির শাসনামলে, সেটা শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়, জাতীয় সংহতির জন্য ক্ষতিকরও বটে।

বিএনপির নেতৃত্বরা ইদানীং ফ্যাসিবাদ কথাটি খুব ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার, উমবার্তো একো ফ্যাসিবাদের যে ১৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে প্রায় অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বিএনপির মধ্যে পাওয়া যাবে।

তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, এই দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করার পেছনে দলটি নিজেই দায়ী। ২০০৭ সালের অষ্টম সংসদীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে, ২০০৪ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে দলটি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তা ছাড়া ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শিশু ও উন্মাদ ব্যতীত কেউ নিরপেক্ষ নয়। তাই এক যুগ ধরে চলা দলটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন জনগণের সমর্থন লাভ করেনি।

অষ্টম দফায় বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ সংশোধন করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দলটির সর্বশেষ শাসনামলে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেসময় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই একতরফাভাবে চারদলীয় জোট সরকার বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) এম এ আজিজকে ২০০৫ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই কমিশন প্রায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারসংবলিত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে। এ ছাড়া ওই সময়ে নির্বাচন কর্মকর্তা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত করা হয়।

আরও পড়ুন

১০ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে বিএনপি একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে স্বাধীন শক্তিশালী বিচার বিভাগ আমাদের সবার কাম্য। তবে কাদের হাত ধরে আসবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? যারা নিজেরাই বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে ব্যর্থ হয়, তাদের মাধ্যমে? ২০০৯ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে যখন বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন সারা দেশের মানুষ এই ট্রাইব্যুনালকে স্বাগত জানালেও বিএনপি-জামায়াত তাদের রাজাকার দোসরদের শাস্তির আওতা থেকে মুক্ত করতে দেশব্যাপী হরতাল–অবরোধের মাধ্যমে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়েছে, যা কিনা বিচার বিভাগের প্রতি তাদের ঔদ্ধত্য ও অপমানজনক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ।

যে রাজনৈতিক দল দলীয় স্বার্থে দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার বিচার প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতে পারে না, তারা দেশের মানুষের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, এ কথা জনগণ বিশ্বাস করে না।

দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ একাধারে চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লজ্জার মুখোমুখি হয়। দুর্নীতি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, অর্থ পাচার, ঘুষ—সব মিলিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতির অপর নাম। শীর্ষ পর্যায়ে হয়েছে দুর্নীতি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ রকম অর্জন যাঁদের ঝুলিতে, তাঁদের নিয়ে ১৩ নম্বর দফায় দেওয়া দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করার আশ্বাস তাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, এটা ভাবা কি খুব কষ্টকল্পনা নয়?

২২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের তালিকা প্রণয়ন করে তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। জনগণ এই দলের এ ধরনের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে না। কারণ, এই দলের ও জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টাসহ নানান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার তাদের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

আরও পড়ুন

বিএনপির নেতৃত্বরা ইদানীং ফ্যাসিবাদ কথাটি খুব ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার, উমবার্তো একো ফ্যাসিবাদের যে ১৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে প্রায় অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বিএনপির মধ্যে পাওয়া যাবে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে একো সাহেব ব্যক্তিগত বা সামাজিক হতাশাকে কাজে লাগানোর কথা উল্লেখ করেছেন।

করোনা মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে না পেতেই বিশ্ব ভুগছে ইউক্রেন যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সচেষ্ট রয়েছে। তাদের কাছে এমন কোনো জাদুর কাঠি নেই, যা দিয়ে তারা বিশ্ব অর্থনীতিকে করোনা ও যুদ্ধের প্রভাব থেকে উদ্ধার করতে পারবে। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল তাঁর জগৎখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’-এ কতগুলো নিউস্পিক (রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ) ব্যবহার করেছিলেন।

যেমন যুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে আখ্যা দিয়েছেন মিনিলাভ (মিনিস্ট্রি অব লাভ)। উমবের্তো একো ফ্যাসিবাদের সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এই নিউস্পিক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। একইভাবে বিএনপি গণতন্ত্রকে নিউস্পিক হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রকৃতপক্ষে দলটির মধ্যে তাদের অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী ও পশ্চাৎপদ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

  • অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান

আরও পড়ুন