যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ সম্ভব নয়

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্ষমতার যে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা চলছে, সেটিকে চলতি শতাব্দীর প্রথমার্ধের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণী বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঠিক কোন ধরনের সংজ্ঞায় আটকানো উচিত হবে, তা নিয়ে খুব কম লোকই একমত হতে পেরেছেন।

কেউ কেউ এটিকে গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে শুরু হওয়া দীর্ঘ দ্বন্দ্বের মতো একটি ‘দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। আবার অন্যরা আশঙ্কা করছেন, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে স্পার্টা (তৎকালীন প্রধান শক্তি) ও এথেন্সের (তৎকালীন উদীয়মান শক্তি) মধ্যে যে আদলে যুদ্ধ হয়েছিল, আমেরিকা ও চীন সেই ধরনের যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাত অনিবার্য—এমন একটি ধারণা সবার মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তব হয়ে ওঠা একটি ভবিষ্যদ্বাণীতে রূপ নিতে পারে।

‘দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ নিজেই একটি বিভ্রান্তিকর শব্দবন্ধ। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীন-আমেরিকা সম্পর্ক যতগুলো ধাপ পেরিয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটু চিন্তা করে দেখুন। ১৯৫০–এর দশকে কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকান ও চীনা সেনারা পরস্পরকে হত্যা করেছে।

এরপর ১৯৭০-এর দশকে চীনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ঐতিহাসিক সফরের সুবাদে এই দুই দেশ কাছাকাছি এসেছিল। এই সময়টাতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারসাম্যমূলক জায়গায় আটকে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে শুরু করে।

১৯৯০–এর দশকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক যুক্ততা বাড়তে থাকে। এর সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা চীনকে যেভাবে মার্কিন অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক ব্যবস্থার জন্য ‘ধাবমান হুমকি’ বলে অভিহিত করছেন, ২০১৬ সালের আগে এমনটি ছিল না।

যদি এই দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত সহিংস সংঘাতে না–ও গড়ায়, তাহলেও তাদের মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ চলমান থাকছে, তার কী হবে?

‘দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা’—এই শব্দবন্ধ দিয়ে যদি সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে বলা যায়, আমরা ইতিমধ্যে সে অবস্থার মধ্যে আছি। তবে যদি ঐতিহাসিক তুলনার জায়গা থেকে দেখি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র–চীন সম্পর্কের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বৈশ্বিক পরিসরে উচ্চ স্তরের সামরিক নির্ভরশীলতা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যত কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত পরস্পর-নির্ভরতা ছিল না। সেই দিক থেকে দেখলে বোঝা যাবে, আজকের চীন-আমেরিকা সম্পর্ক একেবারে ভিন্ন।

আজকের বিশ্বব্যবস্থা এমনভাবে বিন্যস্ত যে আমেরিকা নিজের ও বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি না করে চীন থেকে তার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পূর্ণভাবে তুলে আনতে পারবে না। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এখন শুধু কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রসারের দ্বারা হুমকি বোধ করছে না; তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতায় পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থার হুমকি নিয়েও চিন্তিত।

নিরাপত্তা–সংক্রান্ত কারণে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে আংশিক বিচ্ছিন্ন হতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লোকসানজনক হবে। যুক্তরাষ্ট্রের খুব কমসংখ্যক মিত্রই এই নীতি অনুসরণ করতে রাজি হবে। কারণ, অধিক সংখ্যক দেশ তাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

এ ছাড়া পারস্পরিক নির্ভরতার পরিবেশগত এমন কিছু দিক রয়েছে, যা চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন হওয়াকে অসম্ভব করে তোলে। কোনো দেশ একাই জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি হুমকি বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে না। ভালো হোক খারাপ হোক, আমরা চীনের সঙ্গে একটি ‘সহযোগী প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ আটকে আছি। ফলে এই পরিস্থিতিকে শীতল যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা চলে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

  • জোসেফ এস নাই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক