পুতিন দিচ্ছেন পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি, ইউক্রেন যুদ্ধ তবে কি শেষের পথে

২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান শুরুর পর এই প্রথমবার রাশিয়া ইউক্রেনের বাইরে ন্যাটোর লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সরাসরি হুঁশিয়ারি দিল।ছবি : রয়টার্স

গত সপ্তাহে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সীমানার কাছে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়ার ঘোষণা দেন। ক্রেমলিনের দিক থেকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। তারা বলছে যে এই মহড়া আয়োজনের কারণ হচ্ছে, পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা মোতায়েনের কথা বলেছে এবং তাদের অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে বলেছে।

গত ২ মে কিয়েভে আকস্মিক সফরে গিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন যে যত দিন দরকার তত দিন পর্যন্ত তারা কিয়েভের সহযোগিতা করে যাবে। রুশ ভূখণ্ডে হামলার জন্য ইউক্রেনীয়দের ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবহারের কিয়েভের পরামর্শও দেন তিনি। যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য ফরাসি ও ব্রিটিশদের তৈরি করা স্ট্রম শ্যাডো মিসাইল এবং নিজেদের ড্রোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই প্রসঙ্গ বলতে গিয়েই ডেভিড ক্যামেরন তাঁর এই পরামর্শ দেন।

পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করলেও এখন পর্যন্ত তারা খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে আসছে যে রাশিয়ার মাটিতে হামলা চালাতে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। সে কারণে, এখন পর্যন্ত ইউক্রেন তাদের নিজ দেশে উৎপাদিত ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা করে আসছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বারবার করে তাঁর দিক থেকে বলে আসছেন, ইউক্রেনে ন্যাটোর সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটি ফয়সালা করা দরকার। এ মাসে দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবারও তিনি এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন।

বিস্তারিত কিছু খোলাসা না করলেও মাখোঁ বলেন, এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ বজায় রাখা উচিত। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, সেটা যেন রাশিয়ার কাছে ধাঁধা হিসেবে থেকে যায়।

কিন্তু রাশিয়া ধাঁধার এই খেলায় নামতে রাজি নয়। তারা সরাসরি ইউক্রেনের সীমানাসংলগ্ন দক্ষিণ অঞ্চলের সামরিক জেলায় ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রসহ সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়ে তারা পশ্চিমকে খুব স্পষ্ট বার্তা দিয়ে চেয়েছে।

এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার যে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্রিটিশ ও ফরাসি দূতদের তলব করে এবং তাদের যে ভাষায় তিরস্কার করেছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে।

মাখোঁর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে রাশিয়া তাদের বিবৃতিতে বলেছে এটা ‘প্ররোচনামূলক’ ও ‘ধ্বংসাত্মক’ কর্মকাণ্ড। যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটা আরও কর্কশ। রাশিয়া বলেছে, ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের একটি পক্ষ হয়ে গেল যুক্তরাজ্য।

রাশিয়া সতর্ক করেছে, যুক্তরাজ্যের অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় হামলা চালায় তাহলে ‘ইউক্রেনের ভেতরে ও বাইরে’ যুক্তরাজ্যের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে পারে রাশিয়া।

২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান শুরুর পর এই প্রথমবার রাশিয়া ইউক্রেনের বাইরে ন্যাটোর লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সরাসরি হুঁশিয়ারি দিল। যদিও যুক্তরাজ্য এই প্রথমবার রাশিয়ার কাছ থেকে এ ধরনের হুমকি পেল না।

এখন পর্যন্ত এই সংঘাতের দুটি পক্ষ, খেলার নিয়ম ঠিক করছে এবং যার যার দিক থেকে সতর্করেখা আঁকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা আশা করছে, প্রতিপক্ষ সেই বিপদরেখা অতিক্রম করবে না কিংবা অন্তত দ্বিধা করবে, সেটা অতিক্রম করতে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়ার কথা বলে পুতিন এই সংঘাতের স্বাভাবিক যে সীমা সেটাকে ভেঙে দিয়েছেন। সব কটি না হলেও বেশির ভাগ ট্রাম্প কার্ড এখন খেলার টেবিলে।

২০২১ সালের গ্রীষ্মকালে ফিরে যাওয়া যাক। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ক্রিমিয়া উপকূলে (এটিকে রাশিয়া তার ভূখণ্ডের অংশ বলে মনে করে) প্রবেশ করলে রাশিয়ার নৌবাহিনী সতর্ক করে গুলি ছুড়েছিল। রাশিয়া তখন হুমকিও দিয়েছিল যে এরপর কোনো ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ তাদের জলসীমায় প্রবেশ করলে তারা বোমা মারবে।

চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একটি ভূমিকা রেখেছে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির অজনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির ঘটতে পারে। ফলে তারা খড়কুটোর মতো ইউক্রেন সংঘাতকে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করছে।

এর আগে বরিস জনসনের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। কোভিড মহামারির সময় নিয়ম ভেঙে পার্টি দেওয়ায়, যখন তিনি বেকায়দায় পরেছিলেন তখন ইউক্রেনের জোরালো সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিয়েভে ডেভিড ক্যামেরন যখন সফর করছিলেন, সে সময় যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছিল। যাহোক তাঁর এই সফর ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে কোনো সহযোগিতা করেনি।

এখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে। ইউক্রেন সংঘাতের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে পশ্চিমা নেতারা বক্তব্য দেওয়া ও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্র সাধারণত সমন্বয় করে চলছে। ইউরোপের নেতারা, বিশেষ করে ব্রিটিশ নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ‘মন্দ পুলিশের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর কারণ হলো, তাঁরা চান বাইডেন প্রশাসন যেন আরও সংযত ও যৌক্তিক আচরণ করে।

এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের যে পরিস্থিতি সেটাও পশ্চিমা নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। কয়েক মাস ধরে রাশিয়ার সেনাদের অগ্রযাত্রা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। অতিসম্প্রতি ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলের খারকিভ অঞ্চলে তারা আক্রমণ শুরু করেছে।

যুদ্ধের মোড় ইউক্রেনের পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যে জাদুকরি সমাধান খোঁজা হচ্ছে, সেটা এখন পর্যন্ত ফলশূন্য। অনেক কালক্ষেপণের পর এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা প্যাকেজ অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এই সহযোগিতা ব্যবহার করে রাশিয়ার আক্রমণ রুখে দিতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে। ফলে এ সময়ের মধ্যে রুশরা ইউক্রেনের আরও ভূখণ্ড নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেবে।

পশ্চিমা দেশগুলো নানা রকম বিকল্প হাতে রেখে রাশিয়াকে বিরত রাখতে চায়। তারা রাশিয়াকে এই বার্তা দিতে চায় যে ইউক্রেনে বড় ধরনের হামলা চালালে তার বিপর্যয়কর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

অন্যদিকে রাশিয়ানদের হিসাব হচ্ছে, দিন শেষে পশ্চিমের কাছে কিয়েভের চেয়ে মস্কোর গুরুত্ব বেশি।

এখন পর্যন্ত এই সংঘাতের দুটি পক্ষ, খেলার নিয়ম ঠিক করছে এবং যার যার দিক থেকে সতর্করেখা আঁকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা আশা করছে, প্রতিপক্ষ সেই বিপদরেখা অতিক্রম করবে না কিংবা অন্তত দ্বিধা করবে, সেটা অতিক্রম করতে।

কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়ার কথা বলে পুতিন এই সংঘাতের স্বাভাবিক যে সীমা সেটাকে ভেঙে দিয়েছেন। সব কটি না হলেও বেশির ভাগ ট্রাম্প কার্ড এখন খেলার টেবিলে। নতুন একটি সাম্যাবস্থা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে একটি শান্তি আলোচনা আরও বাস্তব হয়ে উঠছে।

৯ মে পুতিন বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে পশ্চিমাদের উদ্দেশে যুদ্ধংদেহী বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধান পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা তিনি মানবেন না। কিন্তু এসব কঠোর বাগাড়ম্বর ও হুমকি যখন চলছে, অন্তরালে তখন যুদ্ধ সমাপ্তির কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চলছে।

  • লিওনিদ রাগোজিন লাটভিয়ার সাংবাদিক
    আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত