পশ্চিমের অভিজাতরা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন ভয় পাচ্ছে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজেদের শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনেছে এবং তাদের অনুষদগুলোকে ‘চিন্তার অপরাধের’ জন্য প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেছবি: রয়টার্স

১৯৮০ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে একাডেমিক পড়াশোনা ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ব্যবধান শুরু হয়েছিল। সেই ব্যবধান তখন থেকে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবধান এখন সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। অবশ্য যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সেও এ ব্যবধান বেশ স্পষ্ট।

১৯৫০–এর দশকের শুরু থেকে ১৯৭০–এর দশকের শেষের দিকে পশ্চিমে একাডেমিক জ্ঞানচর্চা ও সংবাদমাধ্যম মূলত ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থনে এক হয়েছিল।

উপনিবেশের শিকার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অপরাধ সে সময় প্রায়ই তারা চেপে রাখত; এমনকি সেই অপরাধকে তারা ন্যায্যতা পর্যন্ত দিচ্ছিল।

সাংবাদিক ডেভিড হার্স্টের ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গান অ্যান্ড অলিভ ব্রাঞ্চ’-এর মতো কিছু ব্যতিক্রম প্রকাশনা অবশ্যই ছিল। বইটি ফিলিস্তিনি সংগ্রাম ও ইহুদিবাদী বসতি স্থাপনকারী—উপনিবেশের আগেকার স্বল্প পরিচিত ইতিহাসকে একটি বড়সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।

তবে মোটাদাগে, ১৯৮০–এর দশক পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক সৃষ্টিকর্ম দেখা যায়নি।

১৯৭৯ সালে এডওয়ার্ড সাঈদের ‘দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন’ এবং ১৯৮৩ সালে নোয়াম চমস্কির ‘দ্য ফেটফুল ট্রায়াঙ্গল’ ছিল ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের নতুন একাডেমিক স্কলারশিপের প্রাথমিক ডোজ, যা এই দুই লেখকের খ্যাতির কারণে অধিকসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল।

অবশ্য সাঈদ বা চমস্কির—কেউই মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা দুজনই তুলনামূলক সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন।

তার পর থেকেই ইসরায়েলপন্থী অবস্থান থেকে একাডেমিক জ্ঞানচর্চা সমালোচনামূলক দিকে মোড় নেয়। এই মোড় নেওয়াটা ফিলিস্তিন ইস্যুতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের পাঠ এবং সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যের মধ্যে একটি গভীর ফাটল তৈরি করেছে।

১৯৮০-এর দশকের আগে পশ্চিমে থাকা ফিলিস্তিনি পণ্ডিতদের বিকল্প ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা ছিল অতি সীমিত। কারণ, ১৯৬৭ সালে আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলের জয়ের পর ইসরায়েলপন্থী উচ্ছ্বাস ডান-বাম সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।

উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসবিদ আবদুল লতিফ তিবাওবির সবচেয়ে মূল্যবান বইগুলোর কথা বলা যেতে পারে। ১৯৬০–এর দশকের শেষ থেকে ১৯৭০–এর দশকের শেষের দিক পর্যন্ত বইগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময়ে সামি হাদাবি ও ফয়েজ সায়েগের গবেষণাগ্রন্থগুলোও এসেছিল।

অন্যান্য ভালো প্রকাশনার মধ্যে আছে ওয়ালিদ খালিদি সম্পাদিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রভিত্তিক বই ‘ফ্রম হেভেন টু কনকোয়েস্ট’ এবং ইব্রাহিম আবু-লুঘোদের সম্পাদিত ‘দ্য ট্রান্সফরমেশন অব প্যালেস্টাইন’।

১৯৭১ সালে প্রকাশিত দুটি বই-ই পশ্চিমে বসবাসরত আরব ও ফিলিস্তিনি পাঠকদের ছোট বলয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত সাবরি জিরিসের বই ‘দ্য আরবস ইন ইসরায়েল’-এর ভাগ্যেও তা–ই ঘটেছিল। ফিলিস্তিনে ইহুদি বর্ণবাদের শিকার হওয়া আরবদের নিয়ে লেখা বইটি পশ্চিমে তেমন আলোড়ন তুলতে পারেনি। কারণ, পশ্চিমা ইতিহাসবেত্তারা ‘নতুন ইতিহাস’ দিয়ে একাডেমিক শিক্ষার বলয় ও সংবাদমাধ্যমগুলোকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে এসে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। এই ধারার একটি বড় অগ্রগতি আমরা সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করছি।

বিশেষ করে ৭ অক্টোবর থেকে শাসক রাজনৈতিক শ্রেণি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে মূলধারার মনোভাবের পরিবর্তনকে আমলে নিয়েছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে টেকসই ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রমাণ করেছে, ভিন্নমত হটিয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের বাধ্য করার বিষয়ে কয়েক দশক ধরে তারা যে চেষ্টা চালিয়েছিল, তা কাজে দেয়নি।

গণহত্যাকে সমর্থন করা অবস্থা বজায় রাখার জন্য করপোরেট বিশ্ব ও পুলিশি রাষ্ট্রের মদদ প্রয়োজন হয় এবং সরকারি দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়াতে হয়।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান আন্দোলনকে দমনের জন্য প্রতিটি দমনমূলক হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন রাজনীতিবিদেরা এসব আন্দোলনকে ‘অ্যান্টিসেমিটিক’ তৎপরতা হিসেবে উল্লেখ করে তা বন্ধে কংগ্রেসে শুনানি করতে বাধ্য করেছেন। ব্যবসায়ী নেতারা ‘আপত্তিকর তৎপরতা’ চালানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে শাস্তি দেওয়ার এবং তাদের স্নাতকদের চাকরি না দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপগুলো বিপদের স্তর বাড়িয়ে দেয় এবং এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একাডেমিক জ্ঞানের উৎপাদনকে (এবং চর্চা) আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী করেন।

এর ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজেদের শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনেছে এবং তাদের অনুষদগুলোকে ‘চিন্তার অপরাধের’ জন্য প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে (যেমন এই লেখককে বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে)। এটি ইসরায়েলপন্থী নীতি এবং মিডিয়া কাভারেজের দুর্বলতাকেই উন্মোচন করে। ইসরায়েল যতই বর্বর আচরণ করুক না কেন, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তাদের সমর্থন দিয়ে গেছে।

ইসরায়েলের সমালোচনার জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরাই লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে না। ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তৎপরতা চালাচ্ছে—এমনটা দাবি করে ইসরায়েলের অব্যাহত যুদ্ধাপরাধের নথিপত্র প্রকাশ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও একইভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।

সর্বশেষ হুমকি দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে লক্ষ্য করে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার রায়ের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বিরুদ্ধেও পরবর্তী ব্যবস্থা আসতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, উদারপন্থী পশ্চিমের কোনো প্রতিষ্ঠানই এই দমনমূলক ও শাস্তিমূলক প্রচারণা থেকে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের বিষয়ে পশ্চিমের সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে একমত হতে পারেনি, তাদের নিশানা করা হচ্ছেই।

এখন দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাবানেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের জ্ঞানচর্চার ভিত্তি হিসেবে সরকারি রাষ্ট্রীয় প্রচারকে সমর্থন করতে হবে; মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক অধ্যয়নের ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও করপোরেট শক্তির স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে—এমন কোনো স্কলারশিপ বা বৃত্তি আর দেওয়া যাবে না।

এর অন্যথা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কড়া সাজা দেওয়া হবে। তাদের তহবিল শূন্য করা হবে এবং তাদের সুনাম নষ্ট করে ফেলা হবে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

  • জোসেফ মাসাদ নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে আধুনিক আরব রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের অধ্যাপক