‘কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ’

একজন সাহিত্যিক তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ দেখতে পান। শুধু সাহিত্য রচনা করলেই বা কিছু ছন্দোবদ্ধ বাক্য লিখলেই সাহিত্যিক বা কবি হওয়া যায় না। তিনিই সাহিত্যিক, যিনি কালের স্পন্দন শুনতে পান। বর্তমানের গর্ভেই ভবিষ্যতের জন্ম। অতএব ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা অর্জন করতে হলে বর্তমান সময়ের স্পন্দন অনুভব করতে হবে।

উত্তর–আধুনিক কাল বলতে যা বোঝায়, পশ্চিমা দুনিয়ায় তার উন্মেষের শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, যে যুদ্ধ দেশে দেশে ভাঙন অথবা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম ঘটায়, নির্মাণ করে নতুন সমাজ। একই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে দেয়াল, তৈরি হয় কাঁটাতার। ভাঙে পরিবার, ভাঙে বন্ধন—আত্মীয়স্বজন, দেশান্তরি হয় আপনজন—এসবের তীব্রতার পেছনে বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঘটনাপ্রবাহের ভূমিকা আছে।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কাল যখন শুধুই রবীন্দ্রময়, তখন উত্তর–আধুনিক ভাবধারায় কবিজীবন শুরু করেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কালের কবি জীবনানন্দ এবং তিনি তাঁর সময়ের প্রধান কবি হয়ে ওঠেন। উত্তর–আধুনিক কালে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য নিঃসঙ্গতা, হতাশা, একাকিত্ব, বিচ্ছেদ, ভাঙন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতভাগ, দেশান্তর, শরণার্থীর জীবন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, সীমাহীন দারিদ্র্য। এর সঙ্গে সংগতি টেনে জীবনানন্দ নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতা, চাকরিচ্যুতি, অর্থকষ্ট, স্ত্রীর অবহেলা, নিকটজনের উপহাস ও প্রতারণা, অতৃপ্ত জীবনতৃষ্ণা, ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা ইত্যাদি পাশ্চাত্যের কবিদের মতোই নিজের কবিতারও প্রধান উপজীব্য করে তোলেন।  

আরও পড়ুন

একসময় রাষ্ট্র ছিল না। ছিল রাজ্য, যেখানে ছিল রাজা আর প্রজা। রাজার ইচ্ছামতো জীবন ধারণ করতে হতো প্রজাদের, যে জীবন ছিল কষ্টের। ‘হাতুড়ির নিচে’ থাকা সেই জীবনের নিত্যসঙ্গী ছিল করের বোঝা, শাস্তি, অনাহার-অর্ধাহার, অশিক্ষা, রোগব্যাধি। এর বিপরীতে রিপাবলিক তথা রাষ্ট্র ধারণা প্রবর্তন করেন প্লেটো। সংজ্ঞা দেন আব্রাহাম লিংকন। আর রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ অর্থাৎ শুধু জনগণেরই অধিকার থাকবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার। রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকবে মানুষ—সাধারণ মানুষ। তাই দিকে দিকে শুরু হলো রাজ্য ভেঙে রাষ্ট্র গড়ার কাজ, হলো বিপ্লব, হলো যুদ্ধ, হলো ভাঙচুর আর ধ্বংস হলো মহাফেজখানা। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এসবেরই সাক্ষ্য বহন করে।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে। আশা ছিল, এবার বুঝি আমরা একটি শুভ রাষ্ট্র পাব, কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি? প্রবৃদ্ধির নিরিখে আমরা বলছি আমাদের দেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির নিরিখে জীবনমান নির্ধারণ করা যে একটি ভুল পদ্ধতি, তা এখন সর্বজন গ্রাহ্য। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন নিশ্চিত করে না। কারণ, উন্নয়ন মানেই সবার জন্য উন্নয়ন। উন্নয়নযাত্রায় যদি সমাজের একজন মানুষও বাদ পড়েন, তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। বস্তুত, সিঁড়ির একেবারে নিচে যাঁর অবস্থান, তাঁর জীবনের উল্লম্ফন দিয়েই দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিমাপ করেন বর্তমান কালের অর্থনীতিবিদেরা। বাংলাদেশে ধনী-গরিবের ব্যবধান সমগ্র পৃথিবীতে একেবারে শীর্ষের দিকে। এই উপাত্ত প্রমাণ করে, বাংলাদেশে উন্নয়ন ঘটেছে মুষ্টিমেয় লোকের।

গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান ব্যক্তির স্বাধীনতা, ইচ্ছামতো জীবনযাপনের অধিকার। আমার বিশ্বাস, আমার মত, আমার পথ, আমার পেশা, আমার পোশাক, আমার রাজনীতি, আমার দল এবং আমি কী বলব, কী লিখব—সব আমি নির্ধারণ করব। রাষ্ট্র—এমনকি পরিবারও এটা নির্ধারণ করে দিতে পারে না। এই অধিকার এখন বাংলাদেশে সংকুচিত। ভিন্ন মতের ও ভিন্ন দলের ওপর দমন-পীড়ন এখন অসহনীয় মাত্রায়।

আরও পড়ুন

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত ফেব্রুয়ারি মাসের রিপোর্ট থেকে পাঠক ধারণা করতে পারবেন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, ‘বিরোধী দলকে ঠেকাতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত ১৩ মাসে দেশে ৪৯৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭২ জন নিহত এবং ৭ হাজার ১২৪ জন আহত হয়েছেন।’
র‍্যাব হেফাজতে মৃত্যু বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতের অনেক ঘটনা ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। নিরীশ্বরবাদী মতপ্রকাশের কারণে হত্যার শিকার হয়েছে অনেক মুক্তবুদ্ধির মানুষ, তসলিমা নাসরিনসহ অনেকেই হয়েছেন দেশান্তরি।  

সংখ্যালঘুর জীবনও কাটে এখানে ভয়ে ভয়ে, কখন হামলা হবে বসতবাড়িতে, পূজার ঘরে, কখন ধর্ষিত হবে নারী। নাসিরনগর, রামু, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ অসংখ্য হামলা-অত্যাচারের ঘটনা আজও তাড়িয়ে ফেরে সংখ্যালঘুর অর্ধেক জীবন।  
তার মানে, জীবনানন্দের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা আজও একটি শুভ রাষ্ট্রের সন্ধান পাইনি। শুধু শুভ রাষ্ট্র নয়, সমাজটিও রয়ে গেছে রুগ্‌ণ। আমাদের পরশ্রীকাতরতা, হিংসা-দ্বেষ একদিন অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে যাবে, এই আশঙ্কার কথা অনেক আগেই জীবনানন্দ আঁচ করতে পেরেছিলেন:
...
কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ।
চারদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়—অলীক প্রয়াণ।
মন্বন্তর শেষ হ’লে পুনরায় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ
নেই।
...

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলেও ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো এবং সব ধর্মের মানুষেরই বৈধ অধিকার দেওয়া হলো ভারতের মাটিতে বসবাসের। সব ধর্মের মানুষই তাঁর ন্যায্য অধিকার ভোগ করে আসছিল, কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বিভিন্ন ধরনের অবদমনের শিকার হলো সংখ্যালঘুরা। নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীরের বিশেষ স্ট্যাটাস রদ ইত্যাদি সীমাহীন অসহায়ত্ব সৃষ্টি করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে।

নষ্ট সময়ে অতিষ্ঠ কবি, অবজ্ঞা-অবহেলা-অপমানে আনমনা কবি সামান্য সওদা কিনে বাজারের ব্যাগ ফিরছিলেন ঘরে। ট্রাম নামের যন্ত্রসভ্যতা জীবন কেড়ে নিল জীবনানন্দের। ২২ অক্টোবর ঘটেছিল এই দুর্ঘটনা। আজ এই বিষণ্ন দিনে রাষ্ট্রের দীনতা আর সমাজের পচন আলোচনা করারও তাই শ্রেষ্ঠ সময়।

একবিংশ শতাব্দীর কবি হুমায়ুন আজাদও ঠিক একইভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।’

ভারত রাষ্ট্রের একটি শুভ সূচনা হয়েছিল। আশা ছিল গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ঈশ্বরচন্দ্র যে পরমতসহিষ্ণু, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ও সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বুঝি এবার পূরণ হবে। কিন্তু না, তা হয়নি। আশির দশকেই ওপার বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নষ্ট সময় অবলোকন করেন। নষ্ট সময়ে যাপিতজীবনে অতিষ্ঠ কবি আগুনের কাছে প্রার্থনা করেন, ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি, আমাকে পোড়াও।’ যে ‘চলচ্ছক্তিহীন’ অঙ্গ, যে ‘প্রেম-পরিচ্ছন্নতাহীন’ মন তিনি পুড়িয়ে ফেলতে বলছেন, তা কি নষ্ট সময়েরই ফল নয়? কবি শঙ্খ ঘোষও আশির দশকেই আঁচ করেন, পুঁজিবাদ সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে। লেখেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সহপাঠী একটি সামান্য স্বপ্নও পূরণ করতে পারেনি। এমন বড় কোনো স্বপ্ন ছিল না অমলকান্তির। সে শুধু একটু রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।  

আরও পড়ুন

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলেও ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো এবং সব ধর্মের মানুষেরই বৈধ অধিকার দেওয়া হলো ভারতের মাটিতে বসবাসের। সব ধর্মের মানুষই তাঁর ন্যায্য অধিকার ভোগ করে আসছিল, কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বিভিন্ন ধরনের অবদমনের শিকার হলো সংখ্যালঘুরা। নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীরের বিশেষ স্ট্যাটাস রদ ইত্যাদি সীমাহীন অসহায়ত্ব সৃষ্টি করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে। এরই প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের কবি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় কবি, বেবী সাউ রচনা করেন ‘আমাকে কাশ্মীর ভেবে।’ সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘরে জন্ম নেওয়া এই নারী সংখ্যালঘুর অসহায়ত্ব ও কষ্ট অনুভব করতে সক্ষম হন।

তারই প্রকাশ ঘটে এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে। পাঠকেরও মন ভরে যায় এক অচেনা বিষাদে। কবিতা পাঠককে নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে, দাঁড় করার সময়ের কাঠগড়ায়। বেবী সাউ যখন উচ্চারণ করেন: ‘এ দেশ আমার নয়! এ দেশে অন্ধের চোখে জল/ ...আজ যেখানে যাও,/  রক্তাক্ত জরায়ু নিয়ে পড়ে আছে ভারত আমার।’ তখন আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। ‘দেশ’ কবিতায় তিনি বলছেন, ‘আমাকে কাশ্মীর বলে ছিঁড়ে খেলে, তুমিও ভারত—/ আমার আশ্রয়দাতা, আমার পুরুষ...।’ ‘শহিদ’ কবিতায় তিনি ভারতের কাছে মিনতি করছেন, মৃতদেহ প্রাণহীন বলে তাকে নষ্ট না করতে, অনুরোধ করছেন তাঁকে ভালোবাসা দিতে। কবিতার ভাষায় তিনি যখন বলেন ‘তুমি তাঁকে ভালোবাসা দিয়ো’—তখন আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। পাশাপাশি, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়নের গল্প কবিতার যে শরীর নির্মাণ করে, তা-ও আমাদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করে।

  • ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অফ বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]