সময়টা ২০১০। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি। পল্টনে একটা রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গিয়েছি একটা অনুষ্ঠানের জন্য ভেন্যু নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে। গিয়ে দেখি পুরো কার্যালয় খাঁ খাঁ করছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর প্রায় পাণ্ডববর্জিত সেই কার্যালয়ে একজনের সন্ধান পেলাম। তাঁর কাছে জানতে পারলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটু পরে আসবেন। অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষার সেই বেলা আর শেষ হয় না। প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ওই সংগঠনের যে বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে পার্টি অফিসে গিয়েছিলাম, বাধ্য হয়ে তাঁকে ফোন করলাম। বললেন, কী করবে বলো, এখন তো সবাই শুক্রবারের বিপ্লবী।
ধারে ও ভারে—দুই দিক থেকে প্রভাবশালী বামপন্থী দলগুলো তাদের প্রভাব হারিয়ে কীভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ছিল, তার একটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে ‘এখন তো সবাই শুক্রবারের বিপ্লবী’ বাক্যটি দিয়ে। বৃহত্তর অর্থে প্রথাগত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটা যে রূপান্তর ঘটছিল, তারও সূত্র পাওয়া যায় এখান থেকে।
পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শুক্রবারে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে ইসলামি সংগঠনগুলো। গত দশকের শুরুর দিক থেকেই বামপন্থী দলগুলোও শুক্রবারে কর্মসূচি দিতে শুরু করে। এক দশক পর আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলকেও মূলত শুক্রবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঢুকে পড়তে দেখা যাচ্ছে।
গত শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩) ছিল আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। এই উপলক্ষে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। সাম্প্রতিক প্রবণতার ধারাবাহিকতায় বিএনপির কর্মসূচির দিনেই পাল্টা সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করে দলটি। পাঁচ দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির কর্মসূচির যুগপৎ কর্মসূচি হিসেবে পল্টনে সমাবেশ করে। জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এলডিপি ও গণ অধিকার পরিষদ সমাবেশ করে। সিপিবি ও বাসদের জোটও এদিনে ঢাকায় সমাবেশ করে।
গত জুলাইয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২৯ জুলাই বিএনপি ঢাকায় বড় সমাবেশ করে। এর পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও বড় সমাবেশ করে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। কিন্তু পরের দিন ঢাকার চারটি প্রবেশপথে অবস্থান (কার্যত অবরোধ) কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজপথে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলতে থাকে। তাতে বিএনপির নেতা–কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু জনমনে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে, নির্বাচনের আগে যেমন দেশ সহিংস হয়ে ওঠে, সেই পথেই কি এগোচ্ছে দেশ?
সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোজগতেও যে রূপান্তর ঘটে চলেছে, তার পাঠ রাজনীতিবিদেরা কতটা পড়তে পারেন। একেবারে দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন, এ রকম নেতা-কর্মী ছাড়া তাদের বিপুল যে সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার পরও তাঁরা কেন দলীয় কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন না, সেটা বের করা রাজনীতিবিদদের জন্য জরুরি। ছাত্র-তরুণদের একটা বড় অংশ কেন রাজনীতি মানেই সহিংসতা মনে করেন, তা কি তাঁরা ভেবে দেখেছেন?
কিন্তু পুরো আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা অনেকটাই রক্ষণশীল অবস্থান থেকে কর্মসূচি দিতে থাকে। পুরো সপ্তাহ ঘরোয়া আলোচনা সভার মতো কর্মসূচি তারা পালন করে এসেছে। সপ্তাহ শেষে শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি দিয়ে নেতা–কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করে দলটি।
অন্যদিকে আগস্টজুড়েই জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো। এসব কর্মসূচিতে বড় জমায়েত করে শক্তির জানান দিতে চেষ্টা করেছে দলটি। পাশাপাশি শুক্রবারগুলোয় বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থেকেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে একই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। তবে দেশের রাজনীতির এই আপাত–স্বস্তির পরিবেশ কত দিন স্বস্তিতে থাকবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন বাড়ছে। বিএনপি ও বিরোধীরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।
আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডেঙ্গুর গণট্র্যাজেডির মধ্যে কীভাবে কায়দা করে বেঁচে থাকা যাবে—এই জরুরি প্রশ্নের মধ্যেও সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতি ঘিরে পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো কে কী বলছে, তা নিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ জানাশোনার পরিচয় দিচ্ছেন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গণপরিবহন—সবখানেই যে যাঁর মতো করে পাল্টাপাল্টি ব্যাখ্যা,পাল্টাপাল্টি যুক্তি তুলে ধরছেন। নিজের মতো করে উপসংহার টানছেন।
সামনের জানুয়ারির প্রথমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে স্পষ্ট মেরুকরণের সামনে। ভূরাজনীতির সমীকরণের দিক থেকেও জটিলতম সময়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ছুটির দিনকেন্দ্রিক কর্মসূচির মধ্যে ঢুকে পড়ছে, তাতে করে দেশের ভেতরের ও ভূরাজনীতির চ্যালেঞ্জগুলো কতটা মোকাবিলা করা সম্ভব?
শুক্রবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি সাধারণ মানুষের জন্য অবশ্য স্বস্তিদায়ক। কেননা, ঢাকা বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন বাস অযোগ্য শহর। কর্মদিবসে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে যে সেটাকে নরক গুলজার না বলে উপায় নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোগান্তি ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে কর্মসূচি দেয়—সেটা ভাবা নেহাত শিশুতোষ হবে। কর্মদিবসে কর্মসূচি দিলে তাতে জমায়েত করা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭–৮৮ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। একেবারে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। এখন জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বেশি যে এক বেলা কাজ বন্ধ রেখে মিছিল–মিটিংয়ে যাওয়া তাঁদের পক্ষে দুষ্কর।
সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে তিনটি দলের তিনজন সংগঠকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। প্রত্যেকেই প্রায় একই উত্তর দিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ছুটির দিন ছাড়া অন্য কোনো দিনে নেতা-কর্মীদের সমবেত করা কঠিন। কর্মদিবসে কর্মসূচি থাকলে শুধু সক্রিয় নেতা–কর্মীরা অংশ নেন। সাধারণ দিনে কর্মসূচি দিলে যে লোক হয়, ছুটির দিনে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জমায়েত হয়।
সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোজগতেও যে রূপান্তর ঘটে চলেছে, তার পাঠ রাজনীতিবিদেরা কতটা পড়তে পারেন। একেবারে দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন, এ রকম নেতা-কর্মী ছাড়া তাদের বিপুল যে সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার পরও তাঁরা কেন দলীয় কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন না, সেটা বের করা রাজনীতিবিদদের জন্য জরুরি। ছাত্র-তরুণদের একটা বড় অংশ কেন রাজনীতি মানেই সহিংসতা মনে করেন, তা কি তাঁরা ভেবে দেখেছেন? এসব প্রশ্নের মীমাংসা না করতে পারলে সব রাজনীতি সত্যি সত্যি শুক্রবারের কর্মসূচির বৃত্তে ঢুকে পড়বে।
● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী