অর্থমন্ত্রীর সামনে যে বড় চ্যালেঞ্জ

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার জন্য কলামটি লিখছি না। আমি কলামটি লিখছি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর সামনে যে চ্যালেঞ্জ, তা তুলে ধরার জন্য।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পাকিস্তানের কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মতো কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্তগুলো সারা বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

কূটনীতিকের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০১ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী ২০১৯ সাল থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে পাঁচ বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেছেন। আমরা আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাফল্য কামনা করছি।

আরও পড়ুন

অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান আমার অগ্রজপ্রতিম আতাউর রহমান কায়সারের মেয়ে। তিনি কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁকে প্রতিমন্ত্রী করে আরও বড় দায়িত্বে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর জন্যও আমার শুভকামনা।

বিজয় অর্জনের ৫২ বছর পার করে এসে ২০২৪ সালে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অর্জনগুলো নিয়ে আমাদের আনন্দের বন্যায় ভাসার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালের অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অর্থনীতি ২০২৪ সালের মার্চে অনেকগুলো বিপজ্জনক সংকটে পড়েছে।

এই তালিকায় রয়েছে: প্রথমত, অর্থনীতিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে স্থবিরতা, মারাত্মক ডলার-সংকটের কারণে আমদানি এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের মার্চে ১২০ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন।

দ্বিতীয়ত, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি-পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা।

তৃতীয়ত, দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ।

এসব সমস্যার প্রতিটিই কোনো দেশের অর্থমন্ত্রীর ঘুম হারাম করার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং নতুন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দায়িত্বে ওপরে উল্লিখিত সব সমস্যাকে অবিলম্বে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। সবার আগে নজর দিতে হবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে টাকার ২৮ শতাংশ অবচয়নের কারণে উদ্ভূত মারাত্মক মূল্যস্ফীতি সমস্যার লাগাম টেনে ধরার দিকে। নজর দিতে হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে রুখে দেওয়ার দিকে।

আরও পড়ুন

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা মেটানোর পর ২০২৪ সালের মার্চে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রিজার্ভকে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরানো।

ইতিমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে এলসি খোলা কমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার কমে ৬৫ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই হ্রাসের হার ২৪ দশমিক ৪৩। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আট মাসেও আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু হুন্ডি-ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স প্রেরণকে তেমন নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা অব্যাহত থাকার প্রধান কারণ আন্তব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে হুন্ডি ব্যবসার ডলারের দামের পার্থক্য সাত থেকে আট টাকায় স্থির থাকা। এই পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামের ক্রমবাজারীকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না।

অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে অনুরোধ, অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের জন্য দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘পরামর্শক কমিটি’ গঠন করুন। একই সঙ্গে অবিলম্বে একটি ‘ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন’ গঠন করুন।

হুন্ডি-ব্যবস্থার কারণে পুঁজি পাচারের সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং ও রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, প্রতিবছর কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ চাঙা হওয়া। অবশ্য ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ছে। এ সত্ত্বেও আমার দৃঢ় অভিমত হলো, হুন্ডি-ব্যবস্থার চাহিদা কাঠামোয় অবস্থানকারী পুঁজি পাচারকারীদের প্রতি অবিলম্বে সরকারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে এখন আগের তিনটি প্রধান পদ্ধতিকে ছাড়িয়ে গেছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচার। যে ‘হুন্ডি ডলার’ বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা জোগাচ্ছে প্রধানত দেশের দুর্নীতিবাজেরা ও কালোটাকার মালিকেরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘কালচার’ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন

মার্জিনখোর রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন—হুন্ডি ডলারের সহায়তায় গড়ে উঠছে প্রবাসীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমগুলো। পুরোনো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসা পুঁজি পাচারকে দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত করেছে। অতএব এটাও নতুন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে মনে করি।

দুর্নীতি এখনো বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা রয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র‌্যাঙ্কিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন করা অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।

অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে অনুরোধ, অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের জন্য দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘পরামর্শক কমিটি’ গঠন করুন। একই সঙ্গে অবিলম্বে একটি ‘ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন’ গঠন করুন। তৃতীয়ত, প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির’ শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য কয়েকটি ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন। চতুর্থত, সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের কার্যকরভাবে আয়কর-জালে নিয়ে আসুন। সর্বোপরি, দুর্নীতি দমনকে কার্যকর করার জন্য ২০০৭-০৮ সালে প্রণীত ‘দুর্নীতি দমন অধ্যাদেশের’ আদলে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করুন।

এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এক বছরের মধ্যেই অর্থনীতির সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করি।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক