মানি সুইটার দ্যান হানি বনাম অর্থ যখন বিষের চেয়েও বিষাক্ত

মানি মানি মানি সুইটার দ্যান হানি

মানি মানি মানি সুইটার দ্যান হানি

প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের কাপুরুষ সিনেমা অনেকে নিশ্চয়ই দেখেছেন। কলকাতার সিনেমার এক স্ক্রিপ্টরাইটার গল্পের খোঁজে বেরিয়ে ছোট এক শহরে এসে আটকে পড়েন। তখন তাঁকে বাসায় আমন্ত্রণ জানান সেখানকার চা–বাগানের এক ম্যানেজার। স্ক্রিপ্টরাইটারকে নিজের গাড়িতে করে চা–বাগানের বাংলোয় নিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যানেজার। দুজনের আলাপের সূত্র ধরে তখন মুখে পাইপ টানতে টানতে ম্যানেজার সুর করে গেয়ে উঠলেন এই দুই লাইন।

অর্থ মধুর চেয়েও মিষ্টি—এ হচ্ছে ওই দুই লাইনের অর্থ। যদিও আমরা অর্থসংক্রান্ত একটি প্রবাদবাক্য শুনে বা পাঠ্যবইয়ে পড়ে বড় হয়েছি। সেটি হচ্ছে—অর্থই অনর্থের মূল। মূলত এটি মীর মোশাররফ হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস বিষাদসিন্ধু এর একটি লাইন।

প্রবাদ–প্রবচনের সেই যুগ আর নেই। অর্থ এখন মধুর চেয়ে মিষ্টি হয়ে উঠেছে। নয়তো দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ত না। আবার অর্থ বিষের চেয়েও হয়েছে বিষাক্ত। নয়তো ঋণের টাকা নিয়ে ফেরত দিতে না পেরে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনাও দেখতাম না আমরা।

আরও পড়ুন

একটি দেশের বিপরীতমুখী প্রবৃদ্ধির উদাহরণ হতে পারে এমন—একদিকে অসংখ্য মানুষ কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে অনেক মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছেন অথবা দেশে থাকলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না। করোনা মহামারির সময় থেকে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সে সময় আমরা দেখি, মানুষ কীভাবে ওএমএসের চালের ট্রাকের পেছনে দৌড়াছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, করোনা মহামারি চলাকালীন ২৪ মাসে দেশে কোটিপতির হিসাব বেড়েছিল ২০ হাজার ৯৭২টি। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে, করোনার কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন বা ২৮ লাখ মানুষ।

কোটিপতি বেড়ে যাওয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান কী বলে? বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে, অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর ৩ মাসে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৩২২টি। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে কোটিপতির সংখ্যা কত?

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণখেলাপির চিত্রও আমাদের দেখা দরকার। বলে রাখা যায়, ঋণখেলাপি মানে এখন আর ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে অক্ষম বা সক্ষমতা হারানোর বিষয়টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এটি হয়ে গেছে ব্যাংক লোপাটেরই অংশ। একটি কৌতুকের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, আগে ডাকাতেরা টাকার জন্য ব্যাংক লুট করত, আর এখন ডাকাতেরাই টাকা লোপাটের জন্য ব্যাংক বানায়। অনেকে দেশের বর্তমান ব্যাংক পরিস্থিতি বোঝাতে এ কৌতুক টেনে আনেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ এখন দেড় লাখ কোটি টাকার মতো। অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন, এর বড় একটি অংশই বেনামি ঋণ। বেনামি ঋণ কেমন তার একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। চট্টগ্রাম শহরে একটি কথা শোনা যায়, খাতুনগঞ্জ ও তামাককুন্ডি লেনের অনেক দোকান কর্মচারী জানেনই না তাঁদের নামে লাখ লাখ টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁরা কয়েক হাজার টাকার চাকরি করেন। এ হচ্ছে ঘটনা।

শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। বিদেশে আরাম–আয়েশে জীবনযাপন করছেন তাঁরা। শুধু চট্টগ্রামেই ঋণ নিয়ে গত এক দশকে দেশ ছেড়েছেন পালিয়েছেন চট্টগ্রামের ৩৩ ব্যবসায়ী (বণিকবার্তা অক্টোবর ১০, ২০২৩)।

শহর কিংবা গ্রাম আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। নানা অর্থনৈতিক সাফল্যের জিগির তুলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে সর্বদা আমরা শুনছি। গৎবাঁধা কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে সেগুলো আমাদের বিশ্বাসও করতে বলা হয়। কিন্তু উন্নয়নের সেই জাদুর প্রদীপের নিচে অন্ধকার বৃত্তটা ক্রমে বাড়ছে, সে কি খেয়াল আছে আমাদের? বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে গিয়ে সমাজে যে গভীর ও অদৃশ্য ক্ষত তৈরি হচ্ছে, সেখানে মলম লাগাবে কে?

এর বিপরীতে অল্প টাকা ঋণ নেওয়ার কারণে কৃষককে জেল খাটতে হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা এখন এমন বিপরীতমুখী পর্যায়ে অবস্থান করছে, ঋণ বা ধারদেনার কারণে মানুষের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষ খুন করতেও বাধছে না কারও। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যাক এবার।

৮ এপ্রিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের তালতলা এলাকায় মশিউর রহমান নামের এক ব্যক্তি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছেলেকে হত্যা করে নিজেকেও খুন করেন। স্কুলপড়ুয়া মেয়েও হত্যা করতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

মশিউর রহমান একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার সময় সেই চাকরি চলে যায়। এরপর থেকে তিনি বেকার। নিশ্চয়ই কাজকর্মের চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু কোনোভাবে সফল হননি। জমি কিনতে গিয়ে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সঞ্চয়ও হারান। স্ত্রীই টিউশনি করে চারজনের সংসার চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ধারদেনা ও অভাব–অনটনে শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারলেন না মশিউর।

আরও পড়ুন

তাঁর স্ত্রী বলছেন, ‘আমার স্বামী নিজের সন্তানকে হত্যা করবেন, কল্পনাও করিনি’। মেয়েটাও কীভাবে সারাজীবন মেনে নেবে, তাঁর বাবা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন কিংবা বাবা–ভাইয়ের এমন মৃত্যু। এ ট্রমা থেকে কীভাবে বের হবে সে? অদৃশ্য এক কারাগারেই সারাজীবনের জন্য বন্দী হয়ে গেল যেন এই মা–মেয়ে।

আরেকজন হতভাগ্য মো. আরিফুল ইসলাম। ব্যবসায় লোকসানের কারণে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে একটি কিডনি বিক্রির চেষ্টাও করেন। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় লিফলেট লাগান কিডনি বিক্রির জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি।

পাওনাদারদের ভয়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতেন। এভাবে আর থাকতে না পেরে এটিএম বুথ লুট করার চেষ্টা করেন। সে কাজ করতে গিয়ে খুন করে বসেন বুথের নিরাপত্তাকর্মীকে। ১০ এপ্রিল এ ঘটনা ঘটে। পরে তিনি ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এখন তাঁর শাস্তি হবে, জেল হবে। কী হবে তাঁর স্ত্রী–সন্তানের?

২৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় ঋণের চাপে দুই ছেলেমেয়েকে বিষপান করিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন সালমা বেগম নামের এক গৃহবধূ। তিনি ছয়টি এনজিও ও কয়েক ব্যক্তির কাছ থেকে ১২-১৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। সেই ঋণ শোধ করার চাপে আত্মহত্যা করলেন তিনি।

৫ মার্চ ডয়চে ভেলে বাংলা ‘ঋণের চাপে আত্মহত্যা বাড়ছে কেন?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে এমন অনেকগুলো আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে উঠে আসে দেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থার করূণ চিত্র। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পারার চাপে মানুষ আত্মহত্যাকেই বেছে নিচ্ছেন।

প্রতিবেদনটিতে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘এখানে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। গরিব আরও গরিব হচ্ছেন। যার ন্যূনতম একটা সম্মানবোধ আছে, তিনি হয়তো আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু আমাদের দেশে তো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে অনেকেই আয়েশে জীবনযাপন করছেন। তাদের ওই সম্মানবোধটাই নেই। এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে গরিব আরও গরিব হয়ে যাচ্ছেন। ফলে অনেকে জীবন বাঁচাতে ঋণ নিয়ে সেটিরই ফাঁদে পড়ছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’

এসব ‘ব্যর্থ’ মানুষদের কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ে কবি আবুল হাসানের কবিতা ‘চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ’। যাঁরা সমাজ বা পরিবারের চোখে পরাজিত, কেউ দেখে না একলা মানুষ, চিলেকোঠার মতন যাঁরা আকাশ দেখেন, বাতাস দেখেন, জীর্ণশীর্ণ–ব্যর্থ চিবুক বিষণ্নলাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে, হঠাৎ কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান। এরপর একদিন টুপ করে মরে যান, মানে নিজেকে মেরেই ফেলেন।

শুধু তা–ই নয়, আমরা তো দেখলাম, সন্তানকে নিয়েও মরছেন এসব ‘পরাজিত’ মানুষ। শহর কিংবা গ্রাম আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। নানা অর্থনৈতিক সাফল্যের জিগির তুলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে সর্বদা আমরা শুনছি। গৎবাঁধা কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে সেগুলো আমাদের বিশ্বাসও করতে বলা হয়। কিন্তু উন্নয়নের সেই জাদুর প্রদীপের নিচে অন্ধকার বৃত্তটা ক্রমে বাড়ছে, সে কি খেয়াল আছে আমাদের?

বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে গিয়ে সমাজে যে গভীর ও অদৃশ্য ক্ষত তৈরি হচ্ছে, সেখানে মলম লাগাবে কে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]