ফাডা-উতার ঘষাঘষি, মরিচর সর্বনাশ

চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, তিনি দোষারোপের সংস্কৃতি বিশ্বাস করেন না। প্রায় একই কথা অন্যভাবে বলেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, ‘আমরা কাউকে দোষারোপ করছি না।’

কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে একজন (মেয়র) প্রশ্ন তুলেছেন, ‘খনন করা হলেও খালে পাহাড়সমান মাটি কেন?’ অন্যজনের (সিডিএ চেয়ারম্যান) বক্তব্য, ‘নালা-ড্রেন পরিষ্কার করা তো সিডিএর কাজ না। এটি সিটি করপোরেশনের কাজ।’ অর্থাৎ ‘বলি না, বলব না’ করেও দুটি সংস্থার প্রধানই চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করেছেন, দায়ী করেছেন।

গত ছয় বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানদের নিয়ে ১৮টি সমন্বয় সভা হয়েছে। তাতে সুফল কতটুকু পাওয়া গেল, দুটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির বক্তব্যে তা পরিষ্কার। চট্টগ্রামের মানুষ তাই আক্ষেপ নিয়ে পুরোনো প্রবাদটিই স্মরণ করছেন, ‘ফাডা-উতার ঘষাঘষি, মরিচর সর্বনাশ।’

আরও পড়ুন

আগস্ট মাসের প্রথম সাত দিন ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পূর্ণিমার জোয়ার যুক্ত হয়ে জলাবদ্ধতার ফলে নগরবাসীর জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকেই সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা ইতিমধ্যে দেশের মানুষ জেনে গেছেন।

প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে জলে ডোবা এখন চট্টগ্রামবাসীর নিয়তির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যার সমাধান সিটি করপোরেশন করবে, না সিডিএ?—এ নিয়ে নানা তর্কবিতর্কের মধ্যেই কিন্তু গত ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয় হলে গেল। এতগুলো টাকা ব্যয়ের পর যদি সেই পুরোনো অবস্থা বা তার চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হয়, তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসনের টাকা জলেই ভেসে গেল কি না, সেই প্রশ্ন মানুষের মনে আসবেই।

আসলে সিটি করপোরেশন ও সিডিএ পরস্পরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছে, তার অধিকাংশই সত্য। জলাবদ্ধতা নিরসনের মেগা প্রকল্পে সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে সিডিএ। মোট ১১ হাজার ৩৪৪ কোটির মধ্যে ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বরাদ্দ হয়েছে এ সংস্থার জন্য। বাকি দুটি সংস্থা সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পেয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ১০০ কোটি ও ৯৭ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রসঙ্গে সমন্বয়হীনতার কথাটি ঘুরেফিরে আসছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণটি কেউ খুঁজে দেখেন না।

নগরের ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি খালের কাজ সিডিএর প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু খাল খনন, ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি কাজ যেটুকু সম্পন্ন করা হয়েছে, তার সুফলও যে নগরবাসী পায়নি, তা কি অস্বীকার করতে পারবে সিডিএ?

খালের দুই পাশে দেয়াল দেওয়ার আগে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মাটি উত্তোলনের কথা বলা হয়েছিল। না হলে গতবারের চেয়ে এবার পানি আরও বেশি জমবে বলে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু সিডিএ যতই দাবি করুক, মাটি উত্তোলন করা হয়েছে, সরেজমিনে তার যথার্থতা খুঁজে পাননি সাংবাদিকেরা। মেয়র যে বলেছেন, চাক্তাই খালের তলা পাকা করা হয়েছে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে, মাটি উত্তোলন করা হলে তো তলা দেখা যেত—সেই যুক্তিটিই–বা কীভাবে খণ্ডন করবে সিডিএ?

আবার অন্যদিকে সিডিএ বলছে, সিটি করপোরেশন নালা-নর্দমাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করেনি। এই কথাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক সাফল্যের গল্প সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়, কিন্তু নগরের বাস্তব চিত্র তা বলে না।

বিভিন্ন জায়গায় নালা-নর্দমা অপরিচ্ছন্ন। কারণ, এগুলোর তলা বা পাড় মসৃণ নয়। নালা থেকে বালু বা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ তুলে দিনের পর দিন নালার পাশেই রেখে দেওয়া এখানকার একটি পরিচিত দৃশ্য। বৃষ্টিতে সেই বর্জ্য আবার নালায় গেলে পুরো ব্যাপারটিই পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন

নগরবাসীর অসচেতনতা বা দায়িত্ববোধের অভাবের কথা সিডিএ ও সিটি করপোরেশন উভয় সংস্থার পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। এ বক্তব্যে সত্যতা আছে। নাগরিকেরা একটি পরিচ্ছন্ন, জলাবদ্ধতামুক্ত নগরও চান, আবার নালা-নর্দমা-খাল যত্রতত্র পলিথিন, প্লাস্টিক থেকে শুরু করে ব্যবহার অনুপযোগী লেপতোশক পর্যন্ত ফেলতে দ্বিধা করেন না। এসব ক্ষেত্রে প্রথমত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অধিক তদারকি এবং কখনো-সখনো আইনি ব্যবস্থাই একমাত্র নিদান বলে মনে হয়। বিভিন্ন দেশে এ রকম অসচেতন নাগরিকদের জরিমানা ও শাস্তির আওতায় এনে সুফল পাওয়ার নজির আছে।

পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কয়েকটি বাজারে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। এসব বাজারে পলিথিনের পরিবর্তে অন্য ধরনের ব্যাগের ব্যবহারও কিছুদিন দেখেছি আমরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বহাল রাখা যায়নি। কারণ, কিছু বাজারে বিক্রেতারা তুলনামূলক বেশি মূল্যে খদ্দেরদের কাগজ, পাট বা কাপড়ের ব্যাগ দেবে, আর নগরের বাকি সব দোকানপাট-ফুটপাতে স্বল্পমূল্যের পলিথিনের ব্যবহার চলবে—এই দ্বৈত পন্থা চলতে পারে না।

এখন যেকোনো বাজারে গেলে একজন ক্রেতা মাছ-সবজি-মাংস ইত্যাদি কিনে পাঁচ থেকে সাতটি পলিথিন নিয়ে ঘরে ঢোকেন। সুতরাং পলিথিন বন্ধ করতে হলে এর উত্পাদন ও বিপণনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ না করে কিছুতেই সুফল পাওয়া যাবে না। বিএনপির আমলে বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এই পদ্ধতিতে অনেকটা সাফল্য পেয়েছিলেন। পূর্বতন সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি তাদের কোনো অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত থাকলে তা গ্রহণ করার মধ্যে কুণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রসঙ্গে সমন্বয়হীনতার কথাটি ঘুরেফিরে আসছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণটি কেউ খুঁজে দেখেন না। যেমন সিটি করপোরেশনের মেয়র একটি সভা আহ্বান করলে সিডিএ, পাউবো, ওয়াসা বা অন্য সংস্থাগুলো একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সারে। কিন্তু সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিটি উপস্থিত থাকেন না বলে সভায় উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও হয় না, সিদ্ধান্ত কার্যকরও হয় না।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রসঙ্গে সমন্বয়হীনতার কথাটি ঘুরেফিরে আসছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণটি কেউ খুঁজে দেখেন না। যেমন সিটি করপোরেশনের মেয়র একটি সভা আহ্বান করলে সিডিএ, পাউবো, ওয়াসা বা অন্য সংস্থাগুলো একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সারে। কিন্তু সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিটি উপস্থিত থাকেন না বলে সভায় উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও হয় না, সিদ্ধান্ত কার্যকরও হয় না।

এ কারণেই বহুদিন আগে নগর সরকার গঠনের দাবি তুলেছিলেন সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির (মেয়র) কাছে অন্যান্য সংস্থার শীর্ষ পদের ব্যক্তির জবাবদিহি চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই দাবি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের অনুমোদন পায়নি। আমাদের ধারণা, জবাবদিহির এই যে অনীহা, সেখানেই সমন্বয়ের অভাবের মূল কারণটি নিহিত।

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সবচেয়ে বড় বরাদ্দ কেন সিডিএকে দেওয়া হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা জানি, দীর্ঘদিন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পালন করে আসছে সিটি করপোরেশন। এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা বা লোকবল—সব দিক থেকেই সিটি করপোরেশন যোগ্যতর প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন

তত্কালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন চীনের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় যেনতেনভাবে তৈরি সিডিএর প্রকল্পটিই অনুমোদন করেছিল। আ জ ম নাছির উদ্দীনের ওপর সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নেতিবাচক মনোভাবই প্রকল্পটি সিডিএকে দেওয়ার মূল কারণ বলে জানা যায়।

একসময় দলীয় হাইকমান্ডের আনুকূল্যে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র পদের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেই সুসম্পর্কের অবসান ঘটে। ঊর্ধ্বতন মহলের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অংশের কাজ থেকে বঞ্চিত করা হয় সিটি করপোরেশনকে।

প্রকল্প কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে, সেটা নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ডুবে যাওয়া আর ভেসে ওঠার এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই চায় তারা। দুই সংস্থার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আরও গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক