অটোমান অতীত কেন ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন

হাক্কি আল-আযম। তিনি ১৯৩০ সাল পর্যন্ত অটোমানদের শাসনব্যবস্থায় অটোমান মিনিস্ট্রি অব আওক্বাফের মহাপরিদর্শকসহ বেশ কিছু শীর্ষ পদে ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন।

আরব বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ একটি জটিল বিষয়। অতীতে ফ্রান্স ও ব্রিটেন এবং হালে ইসরায়েল—মোটের ওপর তাদের সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদের বিষয়টি জড়িয়ে আছে। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে বেশির ভাগ সময়ই বাদ থেকে যাচ্ছে অটোমান সাম্রাজ্যের কথা। অথচ অটোমান সামাজ্র্যের এই শাসনকে বলা চলে সুদীর্ঘ ও ‘স্বজাতীয়’।

অটোমান সাম্রাজ্যের পর যে রাষ্ট্রগুলোর উত্থান, তারা অটোমান শাসনকে অটোমান অথবা তুর্কিদের দখলদারত্ব হিসেবে বইপুস্তকে উল্লেখ করে থাকে। আবার আরেকটি পক্ষ অটোমানদের হিংস্রতার কথা বলে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে। অটোমানদের নিয়ে এ ধরনের শব্দচয়ন ভালো বিকায়।

সিরিয়া ও লেবাননে সম্ভবত সবচেয়ে সুপরিচিত অটোমান প্রতিনিধি ছিলেন আহমেদ (জামাল) পাশা। তিনি আবার ‘আল-সাফফাহ’ বা কসাই নামে কুখ্যাত ছিলেন। সিরিয়া ও বৈরুতে তিনি যখন গভর্নর, তখন রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল তুঙ্গে। আরব-অটোমান রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীরা ওই সময় নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর অটোমানদের শাসনকে এভাবেই সাধারণ মানুষ মনে রেখেছে।

কিন্তু ঐতিহাসিক সালিম তামারি যেমনটি বলেছেন, প্রায় চার শ বছর ধরে তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ এবং গতিশীল একটা শাসনব্যবস্থার বদলে ওই চার বছরের সময়কালকে মনে রাখাটা ভুল।

প্রকৃতপক্ষে আরব বিশ্বে অটোমান সাম্রাজ্যের যে ইতিহাস, তাকে শুধু ‘তুরস্কের দখলদারত্ব’ অথবা ‘স্বাধীনতা হরণকারী বিদেশি শক্তি’ বলে অভিহিত করা চলে না। আমরা আসলে ১৫১৬ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত চার শ বছরের ‘দেশীয়’ সাম্রাজ্যকে কীভাবে নেব, তা-ই এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

আরও পড়ুন

অটোমানদের এই শাসনব্যবস্থার নেতৃত্বে মূলত ছিলেন আরব-অটোমানরা। তাঁরা ছিলেন বৈরুতের মালহাম এস বা দামেস্কের আল-আযম অঞ্চলের আরবি–ভাষী মানুষ। অটোমানদের ঔপনিবেশিক প্রকল্পের নকশা, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং সমর্থনসহ সব কাজই করতেন তাঁরা।

আল-আযমরা সিরিয়ার গভর্নরের পদসহ লেভানটাইন প্রদেশের শীর্ষ পদগুলো কয়েক প্রজন্ম ধরে রেখেছিলেন। ইস্তাম্বুলে এই পরিবারেরই একটি শাখা, যাঁরা ‘আযমযাডেস’ নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা প্রাসাদ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, কমিশন এবং শেষের দিকে আব্দ এলহামিদ-২ এবং অটোমানদের দ্বিতীয় সাংবিধানিক শাসনামলে শীর্ষ পদে ছিলেন। মালহাম এস রা ইস্তাম্বুল, বৈরুত, সোফিয়া ও প্যারিসে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রক ছিলেন।

আরব-অটোমানদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নতুন করে ছোট একটি সারাংশ যুক্ত হয়েছে, যেখানে ‘তুর্কি’দের দেখানো হয়েছে পৃথক একটি বিদেশি শক্তি হিসেবে, আরব অভ্যুত্থানকে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আর পশ্চিমা ঔপনিবেশিক দখলদারত্বকে দেখানো হয়েছে অবশ্যম্ভাবী উপসংহার হিসেবে। কারণ, তুরস্ক তখন ইউরোপের রুগ্ণ মানব। ইতিহাসের এই মুছে ফেলা সমস্যাজনক, যদি একে বিপজ্জনক না–ও বলি।

আরব অটোমানরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি ব্যবস্থার মধ্যে আনতে এবং তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের জন্য এসব কথা বেশি সত্য। ওই সময় কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার করা হয়।  

সুলতানের পক্ষ থেকে আরব অটোমানরা ইউরোপ, রাশিয়া ও আফ্রিকার সাম্রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করতেন। ওই সাম্রাজ্যগুলো কীভাবে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা নিতে তাঁরা বসতেন। এ ধরনের প্রকল্পের মধ্যে ছিল ইস্তাম্বুলে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কিংবা আরব উপদ্বীপের হিজাযের সঙ্গে সিরিয়া এবং রাজধানীর যোগাযোগ স্থাপন।

আরব অটোমানরা সব জাতি এবং স্বীকৃত ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে অটোমান জাতি গঠনের কথা ভাবতেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের সাম্রাজ্য বহুসংস্কৃতিভিত্তিক—এমন একটা ভাবনা জনমনে প্রোথিত করতে। কিন্তু এই কল্পনা কখনো বাস্তবে রূপ পায়নি। কারণ, জাতীয়তাবাদী ধারণা অটোমানদের চিন্তাচেতনায় প্রভাব ফেলতে শুরু করে।    

তারপরও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত আরব অটোমানরা তাঁদের যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শক্তির দখলদারি এই অঞ্চলের মানুষকে পশ্চিমা ধাঁচের জাতিরাষ্ট্র গঠনের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে এক জাতি ও এক ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করল। আর বহু সংস্কৃতিভিত্তিক পরিচয় শত বছরের জন্য হারিয়ে গেল। অটোমানদের সাবেক কর্মকর্তারা নিজেদের আরব, সিরিয়া অথবা লেবাননের বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হাক্কি আল-আযম। তিনি ১৯৩০ সাল পর্যন্ত অটোমানদের শাসনব্যবস্থায় অটোমান মিনিস্ট্রি অব আওক্বাফের মহাপরিদর্শকসহ বেশ কিছু শীর্ষ পদে ছিলেন। তিনি হলেন সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী।

এ জাতীয়তাবাদের ধারণাই অটোমান অতীতের কথা ভুলিয়ে দেয়। সভ্য দেশের দাবিদার দেশগুলো এমন এক ভাষ্য তৈরি করেছে, যেখানে ভিন্ন একটি ভূরাজনীতিক বাস্তবতায় জীবনযাপন করা আমাদের প্রপিতামহ কিংবা তাঁদের অভিভাবক ও তাঁদের উত্তর প্রজন্ম নিয়ে আলোচনার কোনো জায়গাই আর নেই।

অথচ বদর দোগান এবং আবদ আল-ঘানিদের (ওসমান) মতো সাধারণ মানুষেরও গল্প আছে। তাঁদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বৈরুতে, পেশায় ছিলেন কারিগর। জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে সীমারেখা তোলার আগে কখনো বৈরুত, কখনো দামেস্ক আবার কখনোবা জাফফায় পরিব্রাজকের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন।

আছে আল-খালিদি ও আল আবিদদের মতো সুবিখ্যাত আরব-অটোমানদের গল্পও। তাঁরা একসময় ইস্তাম্বুলকে নিজেদের বাড়ি বলে মনে করতেন। আবার আলেপ্পো, জেরুজালেম ও দামেস্কেও তাঁদের বসতভিটা ছিল। তাঁদের জীবনের গল্প, কিংবা তাঁদের আত্মীয়স্বজন, সমাজের যে গল্প শত শত বছর ধরে চলে এসেছে সেগুলো হারিয়ে গেছে দাপ্তরিক ভাষ্যের আড়ালে।

আরও পড়ুন

আরব-অটোমানদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নতুন করে ছোট একটি সারাংশ যুক্ত হয়েছে, যেখানে ‘তুর্কি’দের দেখানো হয়েছে পৃথক একটি বিদেশি শক্তি হিসেবে, আরব অভ্যুত্থানকে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আর পশ্চিমা ঔপনিবেশিক দখলদারত্বকে দেখানো হয়েছে অবশ্যম্ভাবী উপসংহার হিসেবে। কারণ, তুরস্ক তখন ইউরোপের রুগ্ণ মানব।
ইতিহাসের এই মুছে ফেলা সমস্যাজনক, যদি একে বিপজ্জনক না–ও বলি।

আমি অটোমান সাম্রাজ্যবিষয়ক এমন একজন ঐতিহাসিক, যার শিকড় আছে ফিলিস্তিন ও লেবাননে। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, কোটি মানুষকে তাঁদের সাম্প্রতিক অতীত থেকে, তাঁদের পূর্বপুরুষ, গ্রাম, শহর ও শহরতলি সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা অপরাধতুল্য। আর এই কাজ করা হয়েছে, একটি ‘অস্থিতিশীল জাতিরাষ্ট্রের সমষ্টিকে’ সুরক্ষা দেওয়ার নামে। এই অঞ্চলের মানুষকে তাঁদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজনীতিক ও জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মিথ্যা ভাষ্যের সামনে।

আরও পড়ুন

আরবি–ভাষী-প্রধান অঞ্চলের মানুষের স্থানীয় ইতিহাস হিসেবে অটোমানদের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। যদি তা করতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের পক্ষে সমসাময়িক যে সমস্যা, সেগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

স্থানীয় শিক্ষার্থীদের প্রতি ইতিহাসের গবেষণা, লেখা, বিশ্লেষণ করা শুধু নস্টালজিয়া নয়। শুধু গৌরবজনক, শান্তিপূর্ণ অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া নয়। আদতে সম্পূর্ণ উল্টো; বরং এই আহ্বান ভালো, মন্দ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের অত্যন্ত কদর্য অতীত নিয়ে জানার। অটোমানদের আমলে ত্রিপোলি, আলেপ্পো ও বসরার মতো নগরের মানুষের যে ইতিহাস, তা আসলে এখনো লেখা হয়নি।

  • মোস্তফা মিনাবী সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ , কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়
    আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম